|
|
কন্যা অনীতার রবিবার কলিকাতায় আগমন
বিমানবন্দরে স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন: তিন মাস ভারতে অবস্থান
(স্টাফ রিপোর্টার) |
|
|
|
নেতাজী সুভাষচন্দ্রের স্বপ্নের ভারতবর্ষকে জানিবার ও দেখিবার জন্য তাঁহার কন্যা প্রিয়দর্শিনী অনীতা রবিবার সুদূর ভিয়েনা হইতে তাঁহার পিতৃভূমিতে প্রথম পদার্পণ করেন।
তাঁহাকে বেশ প্রফুল্ল দেখাইতেছিল। গাঢ় সবুজ রং-এর একখানি রেশমী সাড়ী পরিয়া স্মিত হাস্যে বিমান হইতে অবতরণ করিলে তিনি তথায় অপেক্ষমান জনমণ্ডলীর স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন লাভ করেন।
কয়েকটি বড় বড় রাস্তার মোড়ে সারিবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল জনতার জয়ধ্বনি ভেদ করিয়া তাঁহার গাড়ীখানি সোজা নেতাজী ভবনে চলিয়া যায়। তথায় তিনি তাঁহার পিতার শয়নকক্ষ এবং যে কক্ষ হইতে প্রায় ২০ বৎসরকাল পূর্বে ব্রিটিশ পুলিসের শ্যেন দৃষ্টি এড়াইয়া তিনি অন্তর্ধান হন, সেই কক্ষ এবং নেতাজীর জননীর ব্যবহৃত কক্ষ ও অফিস কক্ষ পরিদর্শনান্তে স্বর্গত শরৎচন্দ্র বসুর ১নং উডবার্ন পার্ক ভবনে পদব্রজে গমন করেন।
শ্রীমতী অনীতা প্রায় তিনমাস ভারতে অবস্থান করিয়া পুনরায় ভিয়েনায় চলিয়া যাইবেন। ভারতে অবস্থানকালে তিনি দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। ইহা ছাড়া, শান্তিনিকেতন এবং ভারতের সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্রগুলি পরিদর্শন করিবেন। নেতাজীর স্মৃতি-পুত যে সব প্রতিষ্ঠান কলিকাতায় আছে সেগুলি পরিদর্শনান্তে তাঁহার কার্শিয়াং, কোহিমা, ডিমাপুর, ইম্ফল যাইবার বাসনা আছে।
নেতাজীর জন্মোৎসব সপ্তাহ ২৩শে জানুয়ারী হইতে ২৯শে জানুয়ারী পর্যন্ত অনীতা কলিকাতায় থাকিবেন।
আজ সোমবার অনীতা দেশবন্ধুর পত্নী শ্রীমতী বাসন্তী দেবীর গৃহে গিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন বলিয়া স্থির আছে। ঐ স্থানে মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ও উপস্থিত থাকিবেন বলিয়া আশা করা যায়।
অপরাহ্ন ২-৪৫মিনিটের সময় কোয়ান্টাস বোরিং বিমানখানি বিমানঘাটিতে অবতরণ করিলে নেতাজীর ভ্রাতুস্পুত্রদের মধ্যে শ্রীঅরবিন্দ বসু এবং ডাঃ শিশিরকুমার বসু তাঁহাকে সাদর সম্ভাষণ জ্ঞাপন করেন। ইহার পর তাঁহাকে বিমান ঘাটির বিশ্রামকক্ষের সম্মুখে অপেক্ষমান বসু পরিবারকে অন্যান্য ব্যক্তিদের নিকট লইয়া যাওয়া হয়। সেখানে তাঁহার পরিবারের ভাইবোন এবং অন্যান্য আত্মীয়বর্গ তাঁহাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান। কেহ কেহ তাঁহাকে ফুলের মালা পরাইয়া দেন, কেহ বা ফুলের মালা উপহার দেন। শ্রীমতী ললিতা বসু অনীতাকে কেটি কণ্ঠহার পরাইয়া দেন। শ্রীঅমিয়নাথ বসু পরিবারের সকলকে তাঁহার সহিত পরিচিত করাইয়া দেন। মাতুল বয়োজ্যেষ্ঠ ডাঃ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর পদধূলি অনীতা শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করেন। অনীতা বাঙলার মেয়ে। |
|
|
রবিবার দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছিবার পর বসু পরিবারের
সহিত গৃহীত অনীতার চিত্র। ফটো: আনন্দবাজার |
ঐ স্থানে পারিবারিক এই মিলন দৃশ্য এক মর্মস্পর্শী রূপ ধারণ করে। অনীতাকে দেখিয়া তাঁহার বোনদের সকলের চোখই অশ্রুসজল হইয়া উঠে। তাঁহারা অনীতাকে সস্নেহে জড়াইয়া ধরেন। হয়ত একদিকে দীর্ঘ আকাঙ্খাকিত মিলনের আনন্দ, অপরদিকে তাঁহাদের অতিপ্রিয় ‘রাঙাকাকার’ স্মৃতি তাঁহাদের মনকে ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিয়াছিল। অনীতারও চোখে জল। বাহিরের লোক যাঁহারা ছিলেন তাঁহারাও বুঝি অশ্রু সংবরণ করিতে পারেন নাই।
বিমান ঘাটির ফটকের দুইপাশে তখন প্রচুর দর্শকের ভিড়। অনীতাকে দেখিবার আগ্রহে তাঁহারা অধীর হইয়া উঠে। অনীতা সহাস্যে তাঁহাদের কাছে আগাইয়া যান এবং অনুরাগী জনতার প্রীতি-অভিবাদনের উত্তরে করজোড়ে বলিয়া উঠেন ‘জয় হিন্দ’। ঐ সময় মুহুর্মুহু ধ্বনি উঠে ‘নেতাজী বসু জিন্দাবাদ’। এই সময় বহু প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি তাঁহাকে ফুলের মালা দিয়া অভ্যর্থনা জানান। নিখিল ভারত ফরোয়ার্ড ব্লক, নিখিল ভারত ইউথ লীগ, পশ্চিমবঙ্গ সমাজসেবা সমিতি এবং আরও নানা সাংস্কৃতিক সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হইতে তাঁহাকে মাল্যভূষিত করা হয়। একখানি গাড়ীতে তিনি বিমানঘাটি ত্যাগ করেন।
বিমানঘাটির বাহিরের চত্ত্বরে অপেক্ষমান জণমন্ডলীর সনির্বন্ধ অনুরোধে তাহাকে কিছুক্ষণের জন্য গাড়ী হইতে নামিয়া জনতারে দর্শন দিতে হয়। অনীতা একটু উঁচু জায়গায় উঠিয়া দর্শকমণ্ডলীকে প্রত্যভিবাদন জানান।
বিমানঘাটি হইতে মোটর গাড়ীর সারি, অনীতার গাড়ীর পিছনে অগ্রসর হইতেছিল। বিমানঘাটি এলাকার বাহিরে জেসফের মোড়ে, নাগেরবাজার, সাটগাছি ও বাগবাজার মোড়ে, পাতিপুকুর, বেলগাছিয়া এবং শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে বহু নরনারী অনীতাকে দর্শনের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়াইয়া থাকেন। অনীতার গাড়ীখানি মৃদুগতিতে অগ্রসর হইতে তাকিলে তাঁহারা করতালি দিয়া তাঁহাকে অভিবাদন জানায়। বেলা প্রায় চারি ঘটিকার সময় অনীতা নেতাজী ভবনের সম্মুকে উপস্থিত হন।
অনীতার আগমন সংবাদ সংবাদপত্রগুলিতে ঘোষণার সুষ্ঠু ব্যবস্থা না হওয়া সত্ত্বেও বহু নরনারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁহাকে সম্বর্ধনা জানায়। তাঁহার আগমনের সংবাদ গোপন রাখার এই প্রচেষ্টায় কোন কোন মহলে ক্ষোভ ও বেদনার সৃষ্টি হয়। তাঁহাদের মতে অনীতা বাংলা তথা ভারতের সর্বজনপ্রিয় নেতাজীর কন্যা বলিয়া তাঁহাকে দর্শনের ও উপযুক্তবাবে সম্বর্ধনা জানানোর সুযোগ দেওয়া উচিৎ ছিল।
নেতাজী ভবনে অনীতা |
|
শয়ন কক্ষে রক্ষিত নেতাজীর একখানি চিত্রের সম্মুখে বসিয়া অনীতা প্রণাম নিবেদন
করিতেছে। নেতাজী ঐ শয়নকক্ষ হইতে ১৯৪১ সালের জানুয়ারী মাসে অন্তর্ধান করেন। |
নেতাজী ভবনের প্রবেশদ্বারে উপস্থিত হইলে জনতা শ্রীমতী অনীতা বসুর সহিত কণ্ঠ মিনাইয়া ধ্বনি তোলে ‘জয় হিন্দ’।
বেলা চারটা নাগাদ অনীতা বিমানঘাটি হইতে এলগিন রোডে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর পৈতৃক বাসভবনের সামনে আসিয়া গাড়ী হইতে নামিলে জনতা ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’ এই আওয়াজ তুলিয়া তাঁহাকে স্বাগত জানায়। অনীতা তাঁহার প্রত্যুত্তর দেন ‘জয় হিন্দ’ ধ্বনিতে। অমনি জনতাও সুভাষচন্দ্রের কন্যার সহিত ধ্বনি তুলে ‘জয় হিন্দ’।
নেতাজী ভবনে প্রবেশ করিয়া অনীতা প্রথমেই আজাদ হিন্দ ফৌজের স্মৃতিস্তম্ভে একটি পুষ্পবলয় স্থাপন করেন। ঐখানে অবিনশ্বর আত্মার প্রতীক প্রদীপশিখা জ্বলিতেছিলপবিত্রতার চিহ্নরূপে সাজান ছিল ফুলদল।
তাহার পর দোতলার উত্তর-পূর্ব দিকের ঘরটি। গত ১৯৪১ সালের ১৭ই জানুয়ারী তারিখে কলিকাতা ত্যাগ করার পূর্বে শেষের কয়টি দিন সুভাষচন্দ্র ঐ ঘরেই বাস করিয়াছিলেন, অহোরাত্র ভারতকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন। বিদায় লইবার পূর্বে তিনি যে খাটে শুইতেন তাহার শুভ্র বিছানার উপর রহিয়াছে সুভাষচন্দ্রের একটি আলোকচিত্র। গৃহত্যাগের কিছুদিন পূর্বে অসুস্থ অবস্থায় এই চিত্র গৃহীত হয়। ছবির ফ্রেমে জড়ানো আছে কংগ্রেস সভাপতির জরির মালাটি। প্রায় বাইশ বছর পূর্বের মালা আজ ম্লান। সুভাষচন্দ্রও ঐ কক্ষ ছাড়িয়া দেশ ত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন প্রায় বিশ বৎসর। তবু তাঁহার স্মৃতি ঐ কক্ষের প্রতি ধূনিকণায় জড়াইয়া আছে। তাঁহার পূজার আসন, গীতাঐ কক্ষে এখনও সেইভাবেই রহিয়াছেযেভাবে রাখিয়া তিনি এক নিশীথে চলিয়া যান।
পিতৃগৃহে পিতার কক্ষে প্রথম প্রবেশ করিয়া অনীতা যখন প্রণাম শেষে ঐ ছবির কাছে নতমস্তকে জোড়হাত করিয়া বসিলেন তখন অনেকেরই চোখ সজল হইয়া উঠিল।
তাহার পর অনীতা উহার পাশে সুভাষচন্দ্রের জননী যে কক্ষে বাস করিতেন সেইখানে গেলেন। ‘মেজদাদা’ শরৎচন্দ্র বসুর সহিত একসঙ্গে গৃহীত আলোকচিত্র। সুভাষচন্দ্র যে কক্ষে বসিয়া কাজ করিতেন সেই গরটিও অনীতাকে দেখান হয়।
উডবার্ন পার্কের গৃহে
ইহার পর অনীতাকে লইয়া বসু পরিবারের ব্যক্তিরা ১নং উডবার্ন পার্কে স্বর্গত শরৎচন্দ্র বসুর গৃহে যান। কিছুক্ষণ পরে বেশবাস পরিবর্তন করিয়া আসিয়া অনীতা সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের সহিত আলাপ করেন। ফিকে সবুজ জমির শাড়ী, কালো জামা, স্বর্ণহার, স্বর্ণকঙ্কণে ভূষিতা অনীতাকে দেখিয়া মনে হয়, বাংলার ঘরের মেয়ে বুঝি ঘরে আসিয়াছে।
পরিস্কার বাংলা বাষায় ‘নমস্কার’ জানাইয়া অনীতা আসন গ্রহণ করিলে জনৈক সাংবাদিক প্রশ্ন করিলেন বাংলা জানেন নাকি?
মৃদু হাসিয়া অনীতা জানাইলেন দুঃখিত, বাংলা প্রায় কিছুই জানি না। তবে এখানে থাকতে থাকতে আশা করি কিছুটা শিখে নেব।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান যে, বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে তিনি এখন আইন অধ্যয়ণ করিতেছেন।
‘আপনার কি আইনজীবী হবার ইচ্ছে আছে?’
‘না না, আইনজীবী হবার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। ঐ পাঠ্যক্রমের মধ্যে অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান সবকিছুই পড়তে হচ্ছে।’
জানা গেল, মাস তিনেক ভারতে থাকাকালীন অনীতা সুভাষচন্দ্রের জন্মস্থান দেখার জন্য কটকে যাইবেন। কার্শিয়াং পাহাড়ে যে গৃহে সুভাষচন্দ্র এবং তাঁহার অগ্রজ শরৎচন্দ্র অন্তরীণ ছিলেন তাহা দেখার জন্য অনীতা কার্শিয়াং যাবেন। ক্রিশমাসের সময় দার্জিলিংয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা আছে।
অনীতার বাসনা পিতৃভূমিকে দেখিবেন, দেশবাসীকে জানিবেন, ভারতের সংস্কৃতি-সাধনার পরিচয় লাভ করিবেন। |
ফিরে দেখা... |
|