|
|
নিত্য দিন যাপনের গ্লানি: দশটা-পাঁচটা
(বিশেষ প্রতিনিধি) |
|
|
|
সুতরাং, বলতে পারিনাভ্যগ্যের লিখন।
প্রার্থনা দিয়ে শুরু হয়েছিল এই জীবন। এই দশটা আর পাঁচটা। অনেক দরখাস্ত, সই সুপারিশ, এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে অনেক ঘুরাঘুরি, টাকুর দেবতা, মানতঅনেক কিছু মিলিয়ে দিনে দিনে রচিত হয়েছিল এ জীবনের পটভূমি। বেকারের পাংশু চোখে দশটা থেকে পাঁচটা সেদিন এক রোমাঞ্চকর দিবস।
মাত্র কয়েকটা দিন, মাসকাবারে কয়েক দপা মাইনে। তারপর লেজার কষতে কষতেই সহসা একদিন আবিস্কৃত হয় জীবনের মূল্য। সানন্দে হরিপদ স্বীকার করেজীবনে আমরাও কলুর বলদ। দশটা আর পাঁচটার চক্রে অবিরাম পাক খায় তার চাকা। পঞ্চান্নের আগে তার বিরতি নেই। হলেও মাথাটা ঘুরবে। দশটা থেকে পাঁচটা ঘিরে সেই মস্ত বৃত্তটা খুঁজবে। মুক্ত-চক্ষু বৃদ্ধ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেনসংসার নামক রথটির চাকায় তবুও তৈল প্রয়োজন। |
|
|
সুতরাং এমনও বলতে পারিনা এজীবন অপছন্দ। বলার সাহস পাইনা। বলতে ভালও লাগে না। তার চেয়ে সেই ভালএই স্বীকৃতি। প্রত্যেকের মনে মনে এই আমাদের ‘জীবন’। যন্ত্রনা নয়, জীবন। বুড়ো কেরানী যাকে বলেনলাইফ। ‘লাইফ হে,লাইফ!’
লাইফ!
টাইম-টেবিলে সাজালে নেপোলিয়ন থেকে অমুকের বড় ভায়রা-ভাই, পৃথিবীর সমুদয় কর্মবীর তৎক্ষনাৎ কুপোকাৎ। ছ’টায় নিদ্রাভঙ্গ,আটটা পাঁচের মধ্যে সব সাঙ্গ। বাচ্চার দুধ, সাতজনের বাজার,জুতো রং থেকে মাথা পালিশ সব। আটটা বারোয় লোকাল। অভ্যাসবশতই বোধহয় বাঁধা লেট তিন মিনিট। সুতরাং, হাতে সময় আছে এখনও দশ মিনিট।
এর মধ্যে বড় মাপের সিকি মাইল রাস্তা, একটা আস্ত ওভারব্রীজ, টিকিট। অবশেষে চলমান ট্রেনে মুঠো পরিমাণ লোহার রড। জানালায় অযুত মুণ্ড, দরজায় নরবাঁধ। আপাতত সব লোহার মানুষ। গুঁতোলেও নট নড়ন চড়ন। সুতরাং ভরসা ঈশ্বর। এই লোহার রড আর ফুটবোর্ডে কড়াকড়ি করে স্থাপিত এই পদযুগল।
যাত্রা শুরু হয়। কেরানী দিগ্বিজয়ে বের হয়। মেদিনী ঝাঁপিয়ে সেই উচ্ছ্বসিত প্রাণধারা (উপস্থিত বাক্সবন্দী। কিছু লেবেল স্বরূপ বাইরে এবং উপরে সাঁটা) ছুটে আসে সাগরের দিকে। সঙ্গে কংক্রীট বাঁধানো রাস্তায় পাল্লা দিয়ে ছুটে মফঃস্বলের বাস। তারও সেই পাঁচালির ষষ্ঠীর অবস্থা: ‘হাতে পো, কাঁধে পো....!’
পথে টায়ারের সঙ্গে সঙ্গে দু’চারটে মাথা ফাটবে, হয়ত দোদুলা মানুষটা এক সময় ছিটকে চাকার নীচে চলে যাবে। একটা মরা ছাগ বা মানবশিশু নিয়ে কিছুক্ষণ উত্তেজিত জটলা হবে,কিন্তু বাস তবুও চলবে। ড্রাইভারের পকেটের মত প্রত্যেক যাত্রীর কলেজের পাশে একটা ঘড়ি। কাঁটা সেখানে এতক্ষণে নিশ্চয় ন’য়ের কোঠা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
সুতরাং, সেই লোহার বাক্সে বসেই তর্ক হবে বিস্তর, চাইকি স্টেশন ঘেরাও, লাইনে বসে সত্যাগ্রহ পর্যন্তকিন্তু চাকা তবুও থামবে না। রেল চলবে। ন’টা বাজে। সমুদ্র নিকটে।
সে এক উদ্বেলিত সাগর। বাইরের বাস রেল মরণ পণ করে ছুটছে, রাজধানীর ঘরে ঘরে ভাতের হাঁড়িতে জীবন তখন টগবগ ফুটছে।
কত হল? নটা পনের? না, আর দেরী নয়। আর দেরী করা যায় না। দিনকাল ভাল নয়। সুতরাং, কিছু সেদ্ধ, কিছু কাঁচা, কিছু মুখে, কিছু নাকে। তারপর দে ছুট। ব্লাইন্ড রেস্। কোনদিকে না তাকিয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে বাসস্টপে। দোকানের বড় ঘড়িটায় এখন স্পষ্টত ন’টা পঁচিশ। দশটায় পুনরায় জীবন। |
|
সাড়ে ন’টা থেকে সাড়ে দশটা। ইংরেজীতে বলে‘পিক আওয়ার’। বাংলায় বলতে পারি ‘ব্রাহ্ম-মুহুর্ত’। রাজধানী এখন এক বিশেষ ধ্যান নিমগ্ন। লক্ষ লক্ষ মানুষের চোখে এখন একটাই লক্ষ: বাস কিংবা ট্রামের নম্বর। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে এখন একটাই অভীষ্ট, বাস কিংবা ট্রামের একটুখানি হাতল।
....ট্রাম,...বাস,...রিক্সা,....ঘোড়ার গাড়ি....ট্যাক্সি। কিন্তু তবুও অকুলান। ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী।’ ডিপোর ফসলেই ভরে আসছে সব। স্টপে স্টপে অগণিত শাকের আঁটি। যাত্রীর করায়ত্ত ট্রামের বলগা। দরজায় শূন্যে ঝোলা মানুষের স্তূপ। এরই মধ্যে জনৈকা প্রার্থীনি। কেউ একজন দাড়িটায় দুটো টান দিয়ে বলে উঠললেডিজ সীট নেই।
দাঁড়িয়েই যাব। আস্তে আস্তে সোনা গেল হতাশ মেয়েটির বেপরোয়া বাসনা।
পেছনের গাড়ি! -পেছনের গাড়ি। বাসটা থামল না পর্যন্ত। অপেক্ষমান একশ মানুষের মুখের ওপর একটা ফাঁকা বাণী ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল। অথচ এদিকে দশটা বাজে প্রায়।....জীবন বিফল হয়ে যায়।
দশটা দশেও পৌঁছোতে না পারলে জীবনের মূল্য কমে যায়। তিনদিন লেট মানে একদিন গেল। একদিন গেল মানে। সুতরাং ভেতরে চলেছে অনবরত শাসানি (‘বাস চালাচ্ছ, না গরুর গাড়ি’?) ক্রমাগত দড়ি ধরে টানাটানি, বাইরে ‘সারভাইভেল’-এর জন্য ‘ফিটেস্ট’দের বেপরোয়া যুদ্ধ।
যারা হেরে যাচ্ছে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে তারা আজও একটু সামনের দিকে। সামনে, মৌলালির মোড়ে সারিবদ্ধ ফিটন, ল্যাণ্ডো। তবুও, তার-ই একটা যদি পাওয়া যায়। ভাড়া মাথা পিছু চার আনা। কোচ বাক্সে ঘষলে আধা। মাত্র দু’আনা। তবে বড্ড স্লো। হক তা। কিন্তু ছাড়ছে না কেন লোকটা?
—আউর এক আদমী লাগেগা। গাড়োয়ান আরও লোক চায়।
এই রিকশা। কেতনা লেগা?
এই ট্যাক্সি। ট্যাক্সি!
বুকটা ধক করে ওঠে। এইটুকু পথ। প্রায় আধদিনের রোজগার। তবুও উঠে পড়া ভাল। নয়ত রিসক নেওয়া হবে। লাইফ রিসক!
লাইফ রিসক? হ্যাঁ, লাইফ রিসক! |
|
জীবন মানে, চাকুরী। চাকুরী মানে, অন্ত দশটা দশে পৌঁছোন চাই। নয়ত ইজ্জত থকে না, হয়ত বা একদিন চাকুরীও থাকে না এবং চাকুরী না থাকলে অবশ্য সেদিন জীবনও থাকে না। দশটার রাজপথে জীবনের নামে তাই জীবন ধরে দেয় ক্ষ্যাপা কলকাতা। মাডগার্ড, হ্যাণ্ডেল, ফুটবোর্ড যেখানে যা পায় তাই আঁকড়ে সে জীবন ধরতে চায়। জামাটা জুতোটা পকেটটা তুচ্ছ। হাতটা মচকে যাওয়া, পাটা ভেঙে যাওয়া, বা মাথাটা ফেটে যাওয়ায়নগণ্য। কখনও কখনও গোটা মানুষটাই চলে যায়।
কিন্তু কেন?
বুড়ো কেরানী হয়ত এবারও ম্লান হেসে বলবেনকারণ, সেইটাই জীবন।
সত্যিই কি তাই? লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে কি একটু অনায়াসগতি করতে পারি না আমরা? একটুখানি স্বচ্ছন্দ,আরও একটু নিরাপদ!
|
ফিরে দেখা... |
|