|
কলিকাতার তরীতে আর ঠাঁই নাই। ‘দুঃস্বপ্নের শহর’ সমস্যার চাপে, ভিড়ের চাপে ডুবুডুবু। ভারতের এই পয়লা নম্বরী শহরকে বাঁচিতে হইবে। তাই সকলের মুখে এক কথা‘হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।’
সেই ‘অন্য স্থানের’ সন্ধান মিলিয়াছে। শহরের কাছেই, দক্ষিণে, ডায়মণ্ডহারবার রোডের দুইপাশে ধানী জমিতে, আট নম্বর মাইল পোস্ট হইতে আঠারো নম্বর মাইল পোস্টের মধ্যে। এই ‘নয়া-কলিকাতায়’ পঞ্চান্ন হাজার একর জমিতে স্থান হইবে চৌদ্দ লক্ষ লোকের। প্রস্তাবিত পরিকল্পনার রূপ দিতে খরচ পড়িবে দুই শত কুড়ি কোটি টাকা।
কলিকাতার বিভিন্ন সমস্যার পটভূমিকায় ঐ নতুন পরিকল্পনার বিশদ বিবরণ জনৈক কংগ্রেস সদস্যের বিশেষ প্রস্তাব মারফৎ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার অধিবেশনে আসিতেছে। আগামী ১৪ই ডিসেম্বর। আলোচনার প্রাক্কালে শুক্রবার বিধানসভা সদস্যের কাছে কলিকাতা ও সংলগ্ন এলাকার উন্নয়ন সম্পর্কে এক পুস্তিকা বিলি করা হয়।
পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য, সমস্যা জর্জরিত শহরের ভিড়ের চাপ কমান এবং বর্তমান চৌহদ্দীর প্রায় গায়ে লাগা এলাকায় ঐ নয়া শহর পত্তন।
পরিকল্পনা বাবদ বরাদ্দ টাকা দুই শতাধিক কোটি থাকিলেও রাজ্য সরকার আশা করেন, ক্রমে উহা অর্থের দিক দিয়া স্বয়ংনির্ভর হইতে পারিবে। শুরুতে শুধু উন্নয়ন বাবদ মাত্র ৭৫ কোটি টাকা কার্যকরী মূলধনের প্রয়োজন পড়িবে।
বিধিবদ্ধ আইনমত ‘পশ্চিমবঙ্গ উন্নয়ন কর্পোরেশন’ নামে একটি সংস্থা এতদুদ্দেশ্যে গঠিত হইয়াছে। সংস্থায় শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে খ্যাতিমান কয়েকজন লোক আছেন। তাঁহাদের উপরই ‘এই অত্যাবশ্যক প্রকল্প’ রূপ দেওয়ার ভার দেওয়া হইয়াছে।
বিশদ বিবরণ
পুস্তিকাতে দেখা যায়, প্রস্তাবিত নয়া শহরের উন্নয়নের ভিতর জল সরবরাহ, পয়ঃপ্রণালী, বিদ্যুতের ব্যবস্থা, কলিকাতার সহিত সংযোগকারী বড় বড় রাস্তা নির্মাণ, বৈদ্যুতিক ট্রেন চালু করা ইত্যাদি আধুনিক জীবনযাত্রার স্বাচ্ছ্যন্দ বিধায়ক অনেক কিছু থাকিবে। সরকার মনে করেন, ‘ধন নয়, মান নয়, এইটুকু বাসার’ আশায় নাগরিকের দল ঐ নয়া শহরের দিকে আকৃষ্ট হইবেনই।
নয়া শহরের প্রাণকেন্দ্র হইতে কিছু দূরে নূতন শিল্প ও কারখানা গড়িয়া তোলার ব্যবস্থাও থাকিবে। তাহা ছাড়া বসবাসের জন্য বাড়ীর প্লট, উদ্যান, বাগান, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য জায়গাতো থাকিবেই।
উন্নয়নের পর ২১ হাজার একর জমি গৃহ নির্মানের জন্য রাখা হইবে। তন্মধ্যে ১৫ হাজার একর অর্থাৎ ৯ লক্ষ কাঠা আবাসিক বাড়ী ও ২ হাজার একর প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক বাড়ী নির্মান এবং আড়াই হাজার একর শিল্প বাবদ এবং দেড় হাজার একর অন্যান্য স্বাচ্ছন্দ্যবিধান বাবদ পৃথক পৃথকভাবে থাকিবে।
শুধু তাহাই নয়, বাকি ৩৪ হাজার একরের মধ্যে শহরের চারিধারে থাকিবে ১৪ হাজার একর সবুজের বেষ্টনী এবং ৯ হাজার একরের খনন এলাকা। ৭৫০ একর এলাকা জুড়িয়া দেখা দিবে নূতন নূতন অসংখ্য রাস্তা। শহরের ভিতরে থাকিবে ৮ হাজার একর জমিতে চমৎকার রাস্তা। মনোরম পার্ক ইত্যাদির জন্য বরাদ্দ আছে ৩ হাজার একর জমি।
বর্তমানে ঐ এলাকায় জনসংখ্যা ১৪৩,৫৩৮ জন। তন্মধ্যে কৃষিজীবীর সংখ্যা ১০৭,০৫২ জন। আন্দাজ করা হইতেছে নূতন শহরে মোটামুটি ১৪ লক্ষ লোকের বসবাসের ব্যবস্থা থাকিবে। অদূর ভবিষ্যতে ১৮ লক্ষ লোকের স্থান সঙ্কুলান সহজেই হইতে পারিবে।
মোট ৫৫ হাজার একর জমির মধ্যে ৩১ হাজার একরকে ৫ফুট উঁচু করা হইবে। শহরের ভিতর কৃত্রিম হ্রদ খনন করিয়া ঐ বাড়তি মাটি তুলিয়া ফেলা হইবে। গঙ্গানদীর পলিমাটিও পাম্প করিয়া ঐ জন্য আনা হইবে।
নয়া শহরে থাকিবে হাসপাতাল, কলেজ, স্কুল, থানা, ডাক্তার ঘর, দমকল, সিনেমা, বাজার, দোকানপাট সবকিছু।
সবইতো হইবে, কিন্তু বর্তমান বাসিন্দা যাঁহারা ঐ শহর পত্তনের জন্য উদ্বাস্তু সাজিবেন, তাহাদের কি হইবে? ব্যবস্থা একটা হইয়াছে। তাহাদের প্রত্যেকের জন্য একটি করিয়া প্লট রাখা হইবে। ঐ প্লট বা বাড়ী নগদ টাকায় বা কিস্তিবন্দিতে তাঁহারা কিনিতে পারিবেন। ক্ষতিপূরণ তো পাইবেনই, নূতন স্থাপিত শিল্প ও ব্যবসায়ে কাজ করার সুযোগও তাহাদের দেওয়া হইবে।
আরও তথ্য
পুস্তিকাতে দেখা যায়, ভবন নির্মানের জন্য থাকিবে ২১ হাজার একর অর্থাৎ ১২.৬ লক্ষ কাঠা এবং প্রতি কাঠা যদি ২ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়, তবে কর্পোরেশন উন্নয়নকৃত জমি বিক্রয় বাবদই ২৫২ কোটি টাকা পাইবেন।
তাহা ছাড়া প্রস্তাব করা হইয়াছে, পূর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তু ও স্থানীয় বাসিন্দা উদ্বাস্তুদের জন্য কিছু বাড়ী তৈরী করা হইবে। যাঁহারা নিজেরাই বাড়ী তৈরি করিতে ইচ্ছুক, তাঁহাদের প্লট বিক্রয় করাতো হইবেই, কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষই বহু বাড়ী বানাইবেন।
কর্পোরেশন স্বল্প ব্যয়ের দেড় লক্ষ বাড়ী ও ফ্ল্যাট নির্মানে হাত দিতে পারেন। তন্মধ্যে অর্ধেক স্থানীয় বাসিন্দা উদ্বাস্তুদের জন্য এবং বাকি অর্ধেক পূর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তুদের জন্য পৃথক করিয়া রাখা যাইতে পারে। যদি এই সকল ফ্ল্যাট বা বাড়ী ঐ দুই ধরণের উদ্বাস্তুদের দিয়াও বাকি তাকে, তাহা হইলে সেগুলি অন্য লোকেদের ভাড়া দেওয়া হইবে বা বিক্রি করা হইবে।
মধ্য ও স্বল্প আয়ের লোকেদের জন্য বাড়ী নির্মানের প্রস্তাবও আছে। তজ্জন্য ৩০ হাজার প্লট মধ্য আয়ের লোকের জন্য এবং ৬০ হাজার প্লট নিম্ন আয়ের লোকের জন্য বানানো হইবে। ঐ বাবদ টাকা ভারত সরকারের গৃহ নির্মাণ পরিকল্পনার টাকা হইতে পাওয়া যাইতে পারে। মধ্য আয়ের লোকের জন্য নির্দিষ্ট বাড়ী সোজাসুজি নগদ টাকায় বা কিস্তিবন্দিতে বিক্রি করা যাইতে পারে। উন্নয়ন কর্পোরেশন আশা করেন, ঐ সকল গৃহ নির্মান পরিকল্পনা কার্যকরী হইলে ন্যায্য দরে ২,৪০,০০০ বাড়ী বা বাড়ীর প্লট বিতরণ করা সম্ভব হইবে।
চাষের জমি দখল বাবদ একর প্রতি ৫ হাজার টাকা দরে ২৫ কোটি টাকা এবং ৫ হাজার একর বাসস্থানের জমি দখল বাবদ একর প্রতি ২০ হাজার টাকা দরে ১০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হইয়াছে। জল সরবরাব বাবদ ১৪.৪ কোটি এবং পয়ঃপ্রণালী বাবদ ২১.৬ কোটি টাকাও ধরা হইয়াছে। ৩১ হাজার একর জমি ৫ ফুট উঁচু করা বাবদ ৪৭.২৬ কোটি, রাস্তা নির্মান বাবদ ৫২.৪১ কোটি, পুল তৈরি বাবদ ৮৯ লক্ষ, পথের বাতি বাবদ ১.৫ কোটি, স্কুল, হাসপাতাল, খেলার মাঠ, টাউন হল ইত্যাদি নির্মান বাবদ ১০ কোটি, ২০ মাইলের তিনটি বড় রাস্তা তৈরি বাবদ ১০ কোটি, ব্রডগেজ রেললাইন নির্মানে রাজ্য সরকারের বরাদ্দ বাবদ ১.৫ কোটি টাকা, ও অন্যান্য খরচ বাবদ ৫.৪৪ কোটিমোট ২০০ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাবে ধরা আছে। তাহা ছাড়া সুদ ও এস্টাব্লিশমেন্ট খরচ বাবদ আরও ২০ কোটি টাকা ব্যয় পড়িবে।
নয়া শহর কেন
কলিকাতা শহরকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের উদ্বেগের অন্ত নাই। বিশ্ব ব্যাঙ্ক মিশন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পর্যন্ত এই ব্যাপারে তাঁহাদের সুচিন্তিত মন্তব্য ও সুপারিশ করিয়াছেন। নয়া শহর পত্তনের কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে পরিকল্পনা রচয়িতাগণ ঐ দুইটি সংস্থার সুপারিশাবলীও উল্লেখ করিয়াছেন। তাঁহারা বলিয়াছেনঃ
যতদিন পর্যন্ত কলিকাতার নাগরিকদের বসবাসের একান্ত অনুপযোগী এবং অসাস্থ্যকর পরিবেশে বস্তি ইত্যাদিতে বসবাস করিতে হইবে। যথেষ্ট পরিমান পানীয় জল বা সুষ্ঠু পয়ঃপ্রণালী ও আবর্জনা পরিস্কারের ব্যবস্থা থাকিবে না, ততদিন পর্যন্ত তাহাদের বিরক্তির অবসান হইবে না।
গত ২০ বৎসরের মধ্যে কলিকাতার জনসংখ্যা শতকরা একশত ভাগ বাড়িয়েছে। কলিকাতা এবং ইহার সন্নিহিত অঞ্চলে জীবিকার্জনের আশায় উদ্বাস্তু সমাগম শহরবাসীদের জীবনযাত্রার সমস্যা আরও জটিল করিয়া তুলিয়াছে। এমন কি এখনও ২০ মাইল দূরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫।৬ লক্ষ লোক প্রতিদিন শহরে আসিয়া থাকেন। বৃহত্তর কলিকাতায় বর্তমান জনসংখ্যা ৬০ লক্ষের কম নয়। ১৯৪৮ সালে ছিল ৩৫ লক্ষ। তন্মধ্যে ৮ লক্ষ উদ্বাস্তু।
খাস শহর এলাকা হইতে লোক অপসারিত করিতে পারিলে ‘সর্বাধিক জটিল’ জল সরবরাহ এবং পয়ঃপ্রণালীর সমস্যা, সামগ্রিক পারিপার্শ্বিক স্বাস্থ্য এবং সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি ব্যবস্থা করা সম্ভব হইবে বেং ইহার ফলে আরও উন্নয়নমূলক ব্যবস্থাদি কার্যকরী করাও সহজ হইবে নয়া শহরে। এই প্রসঙ্গে কলিকাতার সমস্যামূলক সম্পর্কে বিশ্ব ব্যাঙ্ক মিশন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অভিমতাদির উল্লেখ বিশেষভাবে করা হয়।
এই নয়া শহর ছাড়াও কলিকাতার চাপ কমাইতে উত্তর লবণ হ্রদ উদ্ধার করিয়া ৫০ হাজার হইতে ১ লক্ষ পরিবারের বসবাসের ব্যবস্থা হইতেছে।
রাজনৈতিক কারণেও কলিকাতার উপকণ্ঠে নয়া শহর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন আছে। ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া দিয়াছে যে, অবস্থার উন্নতি না হইলে কলিকাতায় এমন এক বিস্ফোরক অবস্থার উদ্ভব হইতে পারে, যাহার ফলে শুধু বাংলা বা শিল্প সংস্থা নয়, অনেক জাতীয় আদর্শ এবং উদ্দেশ্যও ধ্বংস হইতে পারে।
নয়া শহর প্রস্তাবিত কলিকাতা মেট্রোপলিটন জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হইবে। প্রত্যক্ষভাবে বা একটি স্বায়ত্তশাসন সংস্থার সহযোগিতায় কলিকাতা মেট্রোপলিটন অথরিটি নাগরিক কাজকর্মসমূহের দায়িত্ব গ্রহণ করিবেন।
উপনগরীর নির্মানকার্য কবে সমাপ্ত হইবে, পুস্তিকায় তৎসম্পর্কে কিছু বলা হয় নাই। শুধু বলা হয় যে, আর্থিক সামর্থ অনুযায়ী বিভিন্ন অংশে প্রস্তাবিত এলাকার উন্নয়নের কাজ হাতে লওয়া হইবে।
|
|