|
|
৫ পৌষ ১৪১৮ বুধবার ২১ ডিসেম্বর ২০১১
|
|
|
|
|
|
|
তুমি নব নব রূপে এসো
|
বিকেল থেকেই ঢাক বাজছে। সন্ধের আকাশে রঙিন আতসবাজির মালা। বাতাসে বারুদের গন্ধ। আর অল্প ক্ষণ হইচই। তার পরেই দেবী বির্সজনের শোভাযাত্রা। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাবে দইঘাটের দিকে।
বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের এই চণ্ডীপুজো এ বার ২১৯ বছরে পড়ল। আর সেই পুজো ঘিরেই জমজমাট মেলা। সাবেক নাগরদোলা, ঘোড়ার দোলার ক্যাচকোচ আওয়াজের পরিবর্তে নানা আধুনিক বিনোদন-গাড়ি। কোনও এক সময়ের গ্রামীণ মেলাটি ধীরে ধীরে আধুনিক মেলায় পরিণত হয়ে গেল! যদিও পুজো শেষ! তাই বলে মেলাও শেষ না কি? |
|
এর পরেও মেলা কয়েক দিন গড়িয়ে চলবে আপন ছন্দে। যেমন চলে। যদিও বড় বড় দোকান উঠে যাবে। তখন ভাঙা মেলা। সেখানেও কেনাবেচা চলবে।
এগারোটা দিন কেটেছে মহা সমারোহে। মেলা ধরা দিয়েছে নব নব রূপে। বিকেল থেকে রাত, মেলা কখনও ঝাঁপ তুলে গনগনে আঁচে জ্বাল দিয়েছে জিলিপি-রসবড়ার রস। ভরপুর আদরে গামলা ভর্তি হয়েছে পিঠেপুলিতে। আংটা ধরে কড়াভর্তি গুড় গিয়েছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বেসনের নানা আকার, হেসে উঠেছে জিলিপি থেকে গুড়কাঠি। কড়াইতে বালি-ছানচায় ভুট্টা আর বাদামের সহবাসের গরম স্বাদটুকু নিতে কেউই পিছপা হয়নি। প্রস্তুতি চলতে থাকে। দক্ষিণ কলকাতার বাঁধাকপির বড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে উত্তর কলকাতার ফুলকপির চপ।
মেলায় দিনের চিত্রটা আলাদা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পেল্লাই কড়াইয়ের বদলে উনুনে বসে গেরস্থালির কড়া। খুন্তির সোহাগে নড়েচড়ে ওঠে আলু-কপি। কোথাও বা পাঁচমেশালি তরকারি। টগবগে হাঁড়ির ফ্যানে সন্ধের ‘বিক্রেতা’ পরিচয় বদলে হয়ে যায় ব্যস্ত ‘গৃহস্থ’। মেলা শুরুর আগে যাঁরা দূর-দূরান্ত থেকে এসেছিলেন পসরা নিয়ে, বিক্রিবাটার আড়ালে তাঁদের এ-ও এক জীবন।
এক সময় এই মেলা সুরে মাতিয়েছেন ভি জি যোগ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র থেকে সুবীর সেন, অরুন্ধতী হোমচৌধুরী, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দ্রাণী সেন, মনোময় ভট্টাচার্য প্রমুখ। এসেছেন সুচিত্রা সেন থেকে সন্ধ্যা রায়। রীতি মেনেই মানবেন্দ্র-প্রতিমা-অংশুমান রায়দের পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে এ বারের মেলায় উপস্থিত ছিলেন শান্তনু রায়চৌধুরী, ইন্দ্রনীল সেন প্রমুখ। পাশাপাশি বসেছে তরজা, যাত্রা, বাউলগান, ভক্তিমূলক গানের আসর। পালন করা হয় প্রতিবন্ধী দিবস, নারী দিবস, যুব দিবস ও শিশু দিবস। |
|
দম বন্ধ করা ভিড়। নাতির হাত ধরে ঠাকুমা কাঠের হাতাখুন্তির সন্ধানে। সন্ধ্যায় পিঠে আর মোমো-র স্টলে যেন চৈত্রের সেল! সঞ্চালকের গলায় ঝরনা, সুইটি প্লিজ কাঁদে না, দক্ষিণেশ্বরের মামা হাত ছেড়েছেন মামিমার, আলিপুরের বউদিকে চোখে হারিয়েছেন দেওর, জয়নগরের রেবেকার মোবাইল চুরি...।
কৃষ্ণনগর থেকে বাঁকুড়া, সিউড়ি থেকে মেদিনীপুর, শিলিগুড়ি থেকে চন্দননগর, আধুনিক মিকি মাউসের গদি-চেয়ার থেকে মরণকূপ, আচার থেকে চুড়ি হয়ে বেডকভার, শৌখিন ব্যাগ, কাচের বাসন, মাটির অলঙ্কার, রান্নার সরঞ্জামের দরদামকে ছাপিয়ে যায় ব্লেজার পরা পড়ুয়াদের দই-ফুচকার রেষারেষি। ইউনিফর্ম গায়ে হাতে মেহেন্দি পরতেও বসে পড়ে পড়ুয়া।
বেহালার উপকণ্ঠে বড়িশার এই পুজো ১২০০ বঙ্গাব্দে সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের সন্তান মহেশচন্দ্র রায়চৌধুরী শুরু করেন। অগ্রহায়ণের শুক্লাষ্টমীতে পারিবারিক এই পুজো তিন দিনে সীমাবদ্ধ ছিল। কথিত, মন্দির সংলগ্ন পুকুর থেকে একটি ঘট ভেসে ওঠে এবং তা দেবী চণ্ডীর ঘট রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। পাঁঠা বলির সঙ্গে হত মোষ বলিও। ১২৫ বছর পারিবারিক পুজো ছিল। প্রায় ৯০ বছর হল পুজো সর্বজনীন হয়েছে। আজও পুরনো বাড়িতে বারো মাস ঘটে দেবীর পুজো হয়। এখন দেবীর মূর্তি তৈরি হয়, জানালেন মেলা কমিটির সম্পাদক শ্রীকুমার রায়চৌধুরী।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার সামালি অঞ্চল থেকে যে পুতুল নাচের দল এই মাঠে আসত সেই ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত। ছোট্ট শ্রীরূপাকে দেখা গেল জমজমাট মেলায় প্রায় গোত্তা দিয়ে এগিয়ে যেতে। পিছনে মায়ের গলা, ‘ওরে পড়ে যাবি।’ কিন্তু কে কার কথা শোনে! ঠোঁটে আঙুল চেপে চোখ গোল গোল বলল, ‘এক বারও ডাকবে না।’ তখন যে পালা চলছে সীতা হরণ।
মরণকূপ বসেছে বিশাল চৌহদ্দি নিয়ে। সেই কূপের বিকট শব্দের মধ্যে থেকে সার্কাসের স্মৃতি তুলে আনলেন রসিক গল্পকার অরবিন্দ গুহ (ইন্দ্রমিত্র)। ষাটের দশকে সার্কাস বসত এখানে। রাতের সার্কাস ছেড়ে তিনি যেতেন সকালে, তাঁবুতে উঁকি দিতে। খাঁচায় বাঘ দেখার জন্য।
এখন মেলার উনুনগুলো ভাঙা। ছাই উড়িয়ে ছেলেটা থলি ভরেছে আধ পোড়া কয়লায়। আকালের বাজারে ‘মহার্ঘ’ হয়ে পেট ফুলিয়েছে পলিব্যাগে বাসন মাজার ছাই। বাঁশের গায়ে ঝুলছে সদ্য স্নানের জামাকাপড়। এ ছবি যদি দিনের হয় তো রাতের ছবি মোমের আলোয় সামান্য পণ্যটুকু নিয়ে বসে আছেন শেষ বিক্রেতা। পাশে লেজ গুটিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে পাড়ার লুসি, কেলো, ভুলোরা।
|
তথ্য: পাপিয়া মিত্র
ছবি: পিন্টু মণ্ডল |
|
|
|