সদ্যপ্রাক্তন দলের নেতাদের প্রতি ক্ষোভ উদগীরণ অব্যাহত। তবু তারই মধ্যে নিজের নিঃসঙ্গতা টের পাচ্ছেন আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা! সিপিএমে থেকে দলের সঙ্গে লড়াই চালানো আর তার বাইরে গিয়ে পৃথক অস্তিত্ব প্রমাণ করা দু’টো যে এক জিনিস নয়, বহিষ্কারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার রেশ ধরা পড়ল রেজ্জাকের গলায়।
প্রবীণ রেজ্জাক বৃহস্পতিবারও দাবি করেছেন, সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তিনি স্বস্তিই পেয়েছেন। তাঁর কথায়, “ভালই হল, পীরদের পার্টিতে আমি আর নেই! কিছু নেতা দলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছেন। দলটা চালাচ্ছেন ম্যানেজারেরা! ক্যাডারদের সঙ্গে নেতার সম্পর্ক আর নেই। পুরোটাই ম্যানেজারদের সঙ্গে কর্মচারীদের সম্পর্ক।” আলিমুদ্দিনের নেতাদের বিরুদ্ধে এমন তোপ বরাবরই দেগে আসছেন রেজ্জাক। কিন্তু এ বার তাঁকে ভাবাচ্ছে ভবিষ্যতের চিন্তা। মেরুকরণের রাজ্য রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখার ভাবনা। সেই উৎকণ্ঠা এ দিন ধরাও পড়েছে বহিষ্কৃত বিধায়কের চোখে-মুখে। তাঁর বিদায়ের পরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সংশ্লিষ্ট এলাকায় লোকসভা ভোটে সাংগঠনিক ভাবে সিপিএম কি ধাক্কা খাবে? এই প্রশ্নের জবাবেই বেরিয়ে এসেছে রেজ্জাকের স্বীকারোক্তি “কী আর হবে! সিপিএম বট গাছের মতো। দু-একটা পাতা ঝরে গেলে কী এসে যাবে!” রেজ্জাকের বিক্ষুব্ধ মেজাজের সঙ্গে এমন উক্তি যে মানানসই নয়, মেনে নিচ্ছেন তাঁর ঘনিষ্ঠেরাও।
বামফ্রন্ট সরকার থাকার সময় থেকেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেনদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে সরব রেজ্জাক। দলে তা নিয়ে জলঘোলাও হয়েছে বিস্তর। সাম্প্রতিক কালে রাজ্য কমিটির বহু বৈঠক এড়িয়ে গিয়েছেন। আবার যে কয়েকটি বৈঠকে হাজির হয়েছেন, তার অনেকগুলিই উত্তপ্ত হয়েছে রেজ্জাকের বিরুদ্ধে সমালোচনায়। দলের মধ্যে থেকে এত দিন জেহাদ চালিয়ে কিছু করতে পেরেছেন? সিপিএম তাঁর কথা মেনেছে? রেজ্জাকের মন্তব্য, “একটুও নড়াতে পারিনি! সিপিএম নেতারা জগদ্দল পাথরের মতো! ওদের মন নেই। শুধু চেয়ারে মন!” রেজ্জাকের জেলারই প্রাক্তন সতীর্থ এবং অধুনা পিডিএসের রাজ্য সম্পাদক সমীর পূততুণ্ড বলেছেন, “দলে থেকে এ রকম বিশ্ৃঙ্খল আচরণ করা যায় না! আরও আগেই ওঁর দল ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। আবার সিপিএমেরও ভোটের মুখে এমন সময়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হল কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।”
তবে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেওয়ার পরে সিপিএম নেতৃত্ব আপাতত রেজ্জাকের তোপ উপেক্ষা করারই কৌশল নিয়েছেন। তাঁর এ দিনের আক্রমণের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেননি কেউ। সিপিএম নেতারা অবশ্য জানতেনই, ঠোঁটকাটা রেজ্জাক বহিষ্কারের পরে সদর দফতরে কামান দাগা চালিয়ে যাবেন কিছু দিন। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী যদিও এ দিন মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরে রেজ্জাক-প্রসঙ্গে বলেছেন, “বহু বার সতর্ক করা হলেও তিনি তা কানে তোলেননি। তাই দল তাঁকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে দলের কোনও ক্ষতি হবে না।” রেজ্জাকের এ দিনের মন্তব্যের কথা অবশ্য তখন জানা ছিল না শ্যামলবাবুর। তিনি যা বলেছেন, তা সাধারণ ভাবে রেজ্জাক প্রসঙ্গে। বিধানসভায় বহিষ্কৃত রেজ্জাকের আসন আলাদা করার জন্য স্পিকারকে চিঠি দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাড়াহুড়ো করছেন না বাম পরিষদীয় নেতৃত্ব। তাঁরা বলছেন, এখনই তো অধিবেশন নেই!
সিপিএম তাঁকে ছেঁটে ফেলার পরে রেজ্জাকের কাজ যে কঠিন, তাঁর এলাকার রাজনৈতিক সমীকরণ থেকেও তা স্পষ্ট। গত বিধানসভা ভোটে পরিবর্তনের ঝড়েও ক্যানিং (পূর্ব) আসন থেকে জিতেছিলেন রেজ্জাক। কিন্তু তার পরে এলাকায় তৃণমূলের দাপট বেড়েছে, তাঁর সঙ্গীরা পাশ থেকে সরে গিয়েছেন, রেজ্জাকও ক্রমে কোণঠাসা হয়েছেন। বিধানসভা ভোটের পরেই সিপিএমের ক্যানিং জোনাল কমিটির তৎকালীন সম্পাদক এবং রেজ্জাকের ছায়াসঙ্গী সওকত মোল্লাকে বহিষ্কার করা হয়। দলবল নিয়ে তিনি চলে যান তৃণমূলে। আবার পঞ্চায়েত ভোটের আগে খুনের মামলায় জেলে গিয়েছিলেন রেজ্জাকের আর এক সেনাপতি সাত্তার মোল্লা। জামিনে মুক্ত হলেও আদালতের নির্দেশে এখনও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় প্রবেশ নিষেধ সাত্তারের। এই পরিস্থিতিতে রেজ্জাক দলের রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সুর চড়িয়েছেন, আর অন্য দিকে এলাকার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও কমে এসেছে। এ সবের পরিণতিতে পঞ্চায়েত ভোটে ক্যানিং-২ ব্লকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে তৃণমূল। দাপট বেড়েছে আরাবুল ইসলামদের। পঞ্চায়েত-উত্তর পরিস্থিতি দেখেই সিপিএম নেতৃত্ব বুঝে নিয়েছিলেন, রেজ্জাককে তা হলে প্রয়োজনে ছেঁটে ফেলাও যায়। তাঁরা যে ভুল ভাবেননি, রেজ্জাকের বহিষ্কারের পরের ২৪ ঘণ্টায় তাঁর গ্রামের বাড়ি ঘিরে কর্মী-সমর্থকদের ভিড় না-হওয়াতেই তার ইঙ্গিত মিলছে বলে দলের একাংশের দাবি।
জেলা কমিটিতে রেজ্জাক-অনুগামীরা ছিলেন এক সময় সংখ্যাগুরু। কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্বের রোষানলে পড়ার ভয়ে তাঁদের অনেকেই ধীরে ধীরে রেজ্জাকের পাশ থেকে সরে এসেছেন। বাকিরাও যাতে বিভ্রান্ত না-হন, তার জন্য সচেষ্ট হয়েছে সিপিএম। রাজ্য নেতৃত্বের পরামর্শে এ দিনই জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী ও কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় (রেজ্জাকের অনুপস্থিতিতে যাঁর উপরে সাংগঠনিক চাপ বাড়ল) বৈঠক করেছেন ভাঙড় ও ক্যানিং এলাকার নেতাদের সঙ্গে। জেলার রেজ্জাক-ঘনিষ্ঠ এক নেতার বক্তব্য, “নিজের সংখ্যালঘু প্লাস পয়েন্টটা কাজে লাগিয়েছেন রেজ্জাকদা। প্রথমে হজ যাত্রা করে আলাদা সত্তা মজবুত করেছেন। রাজ্য জুড়ে নানা অরাজনৈতিক মঞ্চে যোগ দিয়ে নিজের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করেছেন। তার পরে ধীরে ধীরে সংখ্যালঘু ও দলিতদের নিয়ে দল গড়ার পরিকল্পনা করেছেন।” সিপিএমেরই একাংশের মতে, দল তাঁকে বহিষ্কার করায় শহিদ ভাবমূর্তি কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে পারেন রেজ্জাক। কিন্তু আগামী দিনে কাজ যে সহজ নয়, তা তিনি নিজেও বুঝছেন। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “যতই বিদ্রোহী হোন, একেবারে বহিষ্কারের ধাক্কা মানসিক ভাবে অবসাদ এনে দেয়।” ঈষৎ বিষণ্ণ মন নিয়েই আজ, শুক্রবার দিল্লি রওনা হচ্ছেন রেজ্জাক। পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক হবে ফিরে এসে। |