দেশভাগের ছয় দশক পরও উদ্বাস্তু পরিচয় ঘুচল না নদিয়ার ধুবুলিয়ার কয়েক হাজার বাসিন্দার। এখনও মাথা গোঁজার জন্য তাঁদের সম্বল বলতে দলিলবিহীন এক টুকরো জমি। এমনিতেই সুষ্ঠু আর্থিক পুনর্বাসন মেলেনি। তার উপর বাস্তুহীনের পরিচয় নিয়ে দিন কাটছে গভীর যন্ত্রণায়। নিজের নামে জমি না থাকায় সরকারি প্রকল্পে বাড়ি হয় না ওঁদের। ভিটের দলিল দেখাতে না পারায় আটকে যায় পাসপোর্ট। জমির স্বীকৃতি চেয়ে তাই প্রশাসনের দোরে দোরে ঘুরছে ওঁরা। জমি-জটের কথা বলে পাশ কাটাচ্ছে প্রশাসন।
দেশভাগের পর পূর্ব বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ পশ্চিমবাংলায় ভিড় করেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ছিন্নমূল ওই জনগোষ্ঠীর লোকজনের থাকার জন্য ১০৮টি ক্যাম্প তৈরি হয়। ওই ক্যাম্পগুলির মধ্যে ধুবুলিয়ার ক্যাম্পও ছিল অন্যতম। প্রায় দেড় হাজার একর জমির উপর তৈরি ক্যাম্পে ওপার বাংলার শরণার্থীরা থাকতে শুরু করেন। জেলা উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতর সূত্রে জানা যাচ্ছে, ওই জমির প্রায় অর্ধেকই ছিল কেন্দ্রের প্রতিরক্ষা দফতরের। পরে কিছু জমি প্রতিরক্ষা দফতর রাজ্যের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতরকে হস্তান্তরিত করে। সেই এলাকাগুলিকে কলোনির স্বীকৃতি দেয় উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতর। সারদাপল্লি, বিধানপল্লি, শরৎপল্লি, বাঘাযতীন কলোনি, বাজার কলোনি ও সাত নম্বরের কয়েক হাজার বাসিন্দা এই ভাবেই জমির দলিল পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ‘জমি বিতর্কে’ ধুবুলিয়ার ৩১টি এলাকার হাজার খানেক পরিবার এখনও জমির দলিল পায়নি। ওই এলাকার বাসিন্দারা সরকারের হিসেবে এখনও বাস্তুহারা। ভিটেমাটির বৈধ কাগজপত্র না থাকায় ওই পরিবারের লোকজন সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
বাজার কলোনির বাসিন্দা মনীন্দ্রনাথ দাস বলেন, “ব্যবসার জন্য ঋণ চেয়ে ব্যাঙ্কের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। কিন্তু জমির কাগজপত্র দেখাতে না পারার জন্য বেঁকে বসেন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। শেষমেশ ঋণ পেলাম না।” এই এলাকায় প্রচুর বিড়ি শ্রমিক। জমির দলিল না থাকায় কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অধীনে বাড়ি তৈরির সুবিধা পাচ্ছেন না তাঁরাও। ধুবুলিয়ার ৬ নম্বরের বাসিন্দা পুষ্প মণ্ডল বললেন, “তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে পাটকাঠির বেড়ার ঘরে থাকি কোনও রকমে। শুধু জমির কাগজপত্র না থাকায় সরকারের টাকায় বাড়ি করতে পারলাম না।” দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী পরিবারগুলি ইন্দিরা আবাস যোজনা, আমরা বাড়ি ও গীতাঞ্জলী গৃহ প্রকল্পের সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন এই জমি-জটে। ধুবুলিয়ার ১২ নম্বরের শেফালি মণ্ডল, পার্বতী মণ্ডলদের ক্ষোভ, “আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। ভাঙাচোরা বেড়ার ঘরে বাস করি। সরকার থেকে পাকা বাড়ি পাচ্ছি না। কারণ, সরকারি গৃহ প্রকল্পের আওতায় আসতে হলে নিজস্ব জমি থাকতে হবে।” শুধু গৃহ ও ঋণের সমস্যায় নয়, কাজের সূত্রে ভিন্ দেশে পাড়ি দিতে ইচ্ছুক যুবকেরা জমির দলিল দেখাতে না পারায় পাসপোর্ট পাচ্ছেন না। সমস্যার গভীরতার কথা স্বীকার করে কৃষ্ণনগর-২ ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতির পাক্তন সদস্য প্রসেনজিৎ গুহ বলেন, “ধুবুলিয়ার মানুষ ভোট দেন। পঞ্চায়েত গঠনে অংশ নেন। কিন্তু সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। পাঁচ বছর জনপ্রতিনিধি থাকার সময় মানুষের দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করেছি। কিন্তু কী করব? আমাদের তো হাত-পা বাঁধা।”
ধুবুলিয়াতে জমি-জটটা কোথায়? জেলাশাসক পিবি সালিম বলেন, “ধুবুলিয়ার বেশ কিছু জমি কেন্দ্রের প্রতিরক্ষা দফতরের। তাই ওই জমি আইনগত ভাবে বিলিবণ্টন করা যাচ্ছে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি যাতে জমি সমস্যা মিটিয়ে তা উদ্বাস্তুদের মধ্যে বণ্টন করা যায়।” কৃষ্ণনগর দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক তথা রাজ্যের কারিগরী শিক্ষামন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস বলেন, ‘‘যত দূর জানি ধুবুলিয়ার ওই জমি স্বাধীনতার পর কেন্দ্রের প্রতিরক্ষা দফতরের কাছ থেকে রাজ্য সরকার লিজ নিয়েছিল। তবে তার কোনও কাগজপত্র জেলার ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের কাছে নেই। এই অবস্থায় ক্যাম্পের বাসিন্দাদের পাট্টা দেওয়া যাচ্ছে না। এর ফলে এলাকার লোকজন নানা সমস্যায় পড়ছেন।’’ সমস্যার কথা সকলের জানা। কিন্তু সমাধান কী? ধুবুলিয়ার নবোদয় ‘হাটম্যান কলোনি’র সম্পাদক মানবেন্দ্রনাথ বসু বলেন, ‘‘আমরা জেলার ভূমি সংস্কার দফতর থেকে শুরু করে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতরে একাধিক বার গিয়েছি। কিন্তু পাট্টা দেওয়ার ব্যাপারে কোনও তরফেই সে ভাবে সাড়া পাচ্ছি না।” জমি-জট মিটবে কবে জানা নেই। আশার আলো দেখানোরও কেউ নেই। নিজের নামে ভিটের আশা ছেড়েছেন ধুবুলিয়ার ‘উদ্বাস্তু’রা। |