ফতোয়ার নামে ত্রস্ত হওয়ার দিন কি বিগতপ্রায়? সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ রায়ের পর মুফ্তির জারি করা ফতোয়া অগ্রাহ্য করার অধিকারও ভারতীয় মুসলমান পাইয়া গিয়াছেন। সে ক্ষেত্রে সমাজের রক্তচক্ষু বা সম্প্রদায়ের রুদ্ররোষ যাহাতে তাঁহাদের উপর বর্ষিত না হয়, তাহা নিশ্চিত করার আইনগত ও সাংবিধানিক দায় শীর্ষ আদালত রাষ্ট্রের উপরই ন্যস্ত করিয়াছে। আশার কথা ইহাই যে, নিখিল ভারত মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড-ও এই প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টকে পূর্ণ সমর্থন জানাইয়াছে। বোর্ডের বক্তব্য, মুফ্তি কিংবা অন্য ধর্মীয় অভিভাবকরা যে-ফতোয়াই দিন, সেটা তাঁহাদের অভিমতমাত্র, তাহা কার্যকর করার সাধন যেমন তাঁহাদের নাই, তেমনই তাহা মানিয়া চলিতেও মুসলমানরা আদৌ বাধ্য নহেন। সুপ্রিম কোর্ট এবং ল’ বোর্ডের যুগপৎ বিধান সুস্বাগত। ইহা ক্রমশ সম্প্রদায়-সম্প্রদায়ে আইনগত বৈষম্য দূর করিতে সহায়ক হইবে।
কিছু কাল আগেও ফতোয়ার প্রতাপ এমনই প্রবল ছিল যে, শ্বশুরের দ্বারা ধর্ষিতা অসহায় পুত্রবধূ তাঁহার স্বামীকে পুত্রসম গণ্য করিয়া বিবাহবিচ্ছেদে সম্মত হইতে এবং শ্বশুরকে বিবাহ করিতে বাধ্য হইতেন (ইমরানা-কাণ্ড স্মর্তব্য)। নারীর প্রতি এমন ‘বিধান’ নিয়মিত জারি হইত। প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে ন্যায়বিচারের বাণী এ ভাবেই কাঁদিয়া ফিরিত। যুগের পরিবর্তন হইয়াছে। শিক্ষার প্রসার, বিশেষত মুসলিম মহিলা ও তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা, চেতনা ও চিন্তাভাবনার বিস্তার পরিস্থিতির বদল ঘটাইয়া দিয়াছে। মুসলিম সমাজের আলোকপ্রাপ্ত অংশ ক্রমশ শক্তি সংগ্রহ করিতেছেন এবং সাম্য, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের গুরুত্ব উপলব্ধি করিতেছেন। মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড এ ভাবে সুপ্রিম কোর্টের মতে সায় দিয়া সেই সত্যই প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। লক্ষণীয়, শীর্ষ আদালত কিন্তু ধর্মীয় অভিভাবকদের আদেশ-নির্দেশকে সর্ব ক্ষেত্রেই আইনের মর্যাদা হইতে বিচ্যুত করিয়াছে। কেবল মুফ্তি বা ‘শরিয়তি আদালত’ নয়, হিন্দু সমাজের ধর্মীয় অধিপতিদের বিধানের ক্ষেত্রেও আইনগত বৈধতার জরুরি প্রশ্ন তুলিয়াছে। কোর্টের বক্তব্য, কোনও ব্যক্তি ইচ্ছা করিলে এমন ধর্মীয় অধ্যাদেশ কিংবা ফতোয়া মানিতে পারেন, কিন্তু তাহা করিতে আইনত তিনি বাধ্য নহেন। এই ধরনের তথাকথিত বেসরকারি আদালতের কোনও এক্তিয়ারও নাই জনসাধারণকে তাহা মানিতে বলার। শীর্ষ আদালতের এই রায় অবশ্যই একই সঙ্গে হরিয়ানা-উত্তরপ্রদেশের খাপ পঞ্চায়েত কিংবা পশ্চিমবঙ্গের সালিশি সভার বিচার ও নির্দেশের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য।
এই প্রক্রিয়াটি অভিন্ন দেওয়ানি আইন কায়েম করার ক্ষেত্রেও তাৎপর্যপূর্ণ। দেশ-বিভাগ-উত্তর স্বাধীনতার পরম লগ্নেই ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে জরুরি কাজটি সম্পন্ন করা উচিত ছিল, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি অনুশীলন করিতে গিয়া এবং সংখ্যালঘুর ভোটব্যাংক দখলের তাড়নায় তাহা ইচ্ছাকৃত ভাবেই উপেক্ষিত হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত আইন যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলাদের ক্ষেত্রেই বৈষম্যমূলক হইয়া ওঠে এবং ন্যায়বিচার তাঁহাদের নাগালের বাহিরে চলিয়া যাইতে থাকে, একের পর এক বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত মামলার শরিয়তি বিধানে তাহা স্পষ্ট হইতেছে। বিচারবিভাগ আইন করিতে পারে না, কিন্তু আইনের মর্যাদা রক্ষা করা তাহারই কাজ। সেই কাজের প্রভাব ক্রমশ আইনের উপরেও পড়ে। সুপ্রভাব। |