ভোটের মরসুম আসিয়াছে, প্রাক্-নির্বাচনী জনমত সমীক্ষাও। সেই সমীক্ষা লইয়া বিতর্কও, প্রায় নিয়ম মানিয়াই, আসিয়াছে। অভিযোগ উঠিতেছে, কিছু সংস্থা অর্থের বিনিময়ে তথ্যবিকৃতি ঘটাইতেছে। সত্য, পঞ্চাশ কোটিরও বেশি ভোটারের মন বুঝিতে যে সমীক্ষা করা হয়, তাহাতে বহু পথে কারচুপি সম্ভব। প্রশ্ন হইল, তাহাতে কাহার লাভ? রাজনৈতিক দলগুলির। এখনও বহু মানুষ কাহাকে ভোট দিবেন, সে বিষয়ে মনস্থির করেন নাই। হাওয়া যে দিকে, নিজের ভোটটিও সে দিকেই দেওয়া একটি পরিচিত অভ্যাস। প্রাক্-নির্বাচনী সমীক্ষা সেই হাওয়া-মোরগ। কাজেই, কিছু অর্থের বিনিময়ে কোনও দল সেই হাওয়া-মোরগটিকে নিজের দিকে ঘুরাইয়া লইতে পারিলে তাহার লাভ। এবং, বিরোধী দলগুলির ক্ষতি। অতএব, সমীক্ষায় কারচুপি তাৎপর্যহীন ঘটনা নহে।
কিন্তু, সমীক্ষায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠিয়াছে বলিয়াই সমীক্ষাগুলিকে নিষিদ্ধ করিতে হইবে, বা নজরদারির ব্যবস্থা করিতে হইবে, এমন দাবিতে ১৯৭৫ সালের কুবাস প্রকট। সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। যে কোনও ক্ষেত্রেই ভ্রান্ত তথ্য প্রচার করা অনৈতিক, আইনত অপরাধও বটে। সেই মিথ্যায় কাহারও ক্ষতি হইলে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার অবকাশও বিলক্ষণ আছে। কোনও ভোটার বা কোনও রাজনৈতিক দল বা অন্য কেহ যদি বোধ করেন যে এক বা একাধিক সংস্থার সমীক্ষার ইচ্ছাকৃত ভ্রান্তিতে তাঁহাদের ক্ষতি হইয়াছে, তাঁহারা আইনের পথে হাঁটিতে পারেন। আইনসভার সদস্যরা যদি বোধ করেন যে এই ক্ষেত্রে বর্তমান আইনটি যথেষ্ট কঠোর বা কার্যকর নহে, যথারীতি আইন সংশোধন বা নূতন আইন প্রণয়নও সম্ভব। গণতন্ত্রের আরও একটি দাবি আছে। সম্প্রতি কংগ্রেস নির্বাচনী সমীক্ষায় কারচুপি লইয়া সরব হইয়াছে। কোন সমীক্ষায় কোথায় কারচুপি, কেন তাহা আপত্তিকর, এই কথাগুলিকে জনসমক্ষে লইয়া আসা তাহাদের কর্তব্য নহে কি? নিষেধাজ্ঞার রাস্তাটি গণতন্ত্রের পরিপন্থী।
কেহ বলিতেই পারেন, সমীক্ষার কারচুপির সহিত জনস্বার্থ জড়িত, কাজেই তাহার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা সরকারের কর্তব্য। কথাটি কিঞ্চিৎ গোলমেলে। সত্যই যদি কেহ কেবলমাত্র একটি বা একাধিক বিকৃত সমীক্ষার ফলের উপর নির্ভর করিয়াই ভোট দেন এবং পরে বুঝেন যে কাজটি তাঁহার স্বার্থবিরোধী হইয়াছে, তবে তাঁহার দুর্ভাগ্য। ভোটদানের অধিকারের সহিত সচেতনতার সম্পর্ক খুব দূরবর্তী নহে, তাহা বিস্মৃত হইলে মুশকিল। জনস্বার্থের এই যুক্তি ব্যবহার করিয়া কোনও বেসরকারি সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা চলে না। কোন সংস্থা কোন নমুনার উপর ভিত্তি করিয়া, কোন পদ্ধতিতে ফলাফলে উপনীত হইবে, তাহা সংস্থার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। সরকারের বাঁধিয়া দেওয়া পথে চলিতে তাহাকে বাধ্য করা চলে না। সমীক্ষার পদ্ধতি প্রকাশ করিতেও নহে।
তবে কি কারচুপি চলিতে দেওয়াই ভবিতব্য? তাহা নহে। সরকার যাহা করিতে পারে না, বাজার স্বচ্ছন্দে তাহাই করিয়া থাকে। এই ক্ষেত্রেও বাজারেই সমাধান। প্রাক্-নির্বাচনী সমীক্ষা যদি ভোটের ফলাফল আঁচ করিতে বারংবার ব্যর্থ হয় ২০০৪ এবং ২০০৯-এ যেমন হইয়াছে তবে সেগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা লইয়া প্রশ্ন উঠিবেই। কারচুপির চেষ্টা হইলে তাহাও শেষ অবধি বাজারেই উন্মোচিত হইবে। বস্তুত, কিছু অসৎ সংস্থার কারণে সৎ সংস্থাগুলিরও ক্ষতিই হইতে পারে। এই কথাটি সকল সংস্থাই জানে। ফলে, নিজেদের অস্তিত্ব এবং বাজার টিকাইয়া রাখিতেই সৎ সংস্থাগুলি সম্ভবত অধিক সক্রিয় হইবে। নূতন সংস্থা আসিবে, কিছু সংস্থা বাজার ছাড়িবে। সেই প্রক্রিয়াটি প্রকৃত প্রস্তাবে কী হইবে, তাহা ভবিষ্যৎই বলিতে পারে। কিন্তু, দীর্ঘমেয়াদেও অসততাই বাজার ধরিয়া রাখিবে, এমন শুভনাস্তিকতা সম্ভবত বাস্তবরহিত। তত দিন ধৈর্য ধরিয়া থাকাই গণতন্ত্রের পরীক্ষা। |