হাঁড়ির খবর
লসে, নিকম্মার ঢেঁকি লোকজন নিউ ইয়ার ইভে একটু এক্সটিক আমেজে মজতে পারবে না, এ কথা কোন অভিধানে লেখা আছে?
সাকলিং পিগ বা ডাক-টার্কি খায়, না মাথায় দেয় জানেন না, অথচ চাখার জন্য ছোঁকছোঁক করছেন এমন অভাগা এ শহরে দেদার আছে। তাদের গলা কাটতে এ শহরে জাঁকালো আয়োজনেরও অভাব নেই। ছিবড়েমার্কা হাঁসের মাংস ফ্লপ হওয়ার ভুরি ভুরি নমুনা আছে। বছরে কদাচিত্‌ প্যাঁটার ঝোল ও শীত পড়লে চিলি চিকেন-তন্দুরিযোগে মদ্যপান অবধি যাদের দৌড়, ক্র্যানবেরি সস দিয়ে টার্কিব্রেস্ট তাঁদের মুখে রুচবেই এমন গ্যারান্টি নেই। বচ্ছরকার এই উইক-এন্ডে একটু পয়সা উসুলে অতএব কী করা যেতে পারে।
সুইন হো স্ট্রিটের ফিশ ফিশে ঢুঁ মারা ইস্তক আইডিয়াটা সুড়সুড়ি দিচ্ছে। অমুক-তমুক ক্লাবে চিল-চিত্‌কারপ্রবণ ঝাপসারঙা পার্টির স্বাদ থেকে মুখ বদলে ধরা যাক, নিজের বাড়িতেই ইয়ারদোস্ত নিয়ে নরক গুলজার। আর মাঝেমধ্যে ঘুরে ফিরে ধোঁয়াগন্ধমাখা চিংড়িমাংস দেখা দিচ্ছে। চিংড়ি বলে কি তাকে ছোট করা হল! প্রায় চিকেন টিক্কার আকারে এক একটি খণ্ড। মাখনের মতো তুলতুলে ল্যাতপেতিয়ে গেলে এ স্বাদের মজা পাবেন না। আবার রবারের মতো শক্ত বা ইলাস্টিকের মতো ছিবড়ে হলেও মাটি! এই কমনীয়তা যথার্থই দন্তোপযোগী। মুখে দিলে যাবতীয় ইন্দ্রিয়ানুভূতি ‘বস্‌ তোমার পানে’ বলে ধাবমান। নাঃ, চিংড়ি নয়, এর নাম লবস্টার।
আর এই ধোঁয়াগন্ধ, কাঠকয়লার কেসটা কী? ওটা বার্বিকিউ সসের মহিমাতেও অসম্ভব নয়। সেই উদার লন খুঁজে ওপেন বার্বিকিউয়ের বন্দোবস্ত করতে আপিস কামাই হল না, তবু পোড়া মাংসের একটা ছায়া-ছায়া আভাস জীবনে উঁকি দিয়ে গেল, এই ব্যস্ত নাগরিক জীবনে খুব খারাপ সওদা বোধহয় নয়। আরে, অন্তত রেডি টু ইট চিকেন-টিকেন বা ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের দুর্লঙ্ঘ্য নিয়তির থেকে ঢের ভাল সুযোগ।
ফিশ ফিশে লবস্টার ইন বার্বি কিউ সস চাখতে চাখতেই এ সব যুক্তি মাথায় এল। লবস্টার দামের থেকে খানিকটা উঁচকপালে বলাই বাহুল্য। তবে ভ্যালু ফর মানির মর্যাদায় ক্ষুণ্ণ করে। এক কেজি-র প্রাণীটির গা থেকে ৪৫০ গ্রাম মাংস হয়। এক অংশই তিন জনে চাখা যাবে।
এই তথ্যটুকুর বাইরেও মাথায় রাখতেই হয় লবস্টারের কতটা দুর্লভ। ১০০ কি ১৫০ বছর আগের কলকাতায় শুধু হুগলি নদীতে ঢাউস জাহাজ ভিড়ত কে বলেছে, ফ্রেশ লবস্টার বা অয়েস্টারও তখন আকছার মিলত। এখন রূপকথা পেলিতির মেনুতে এ সব কিংবদন্তি লেখা আছে। কিন্তু আজকের কলকাতায় পাঁচতারার বাইরে প্রকৃত লবস্টার খুঁজে পেতে মাথা খুঁড়তে হবে। সাধে গোয়া, মুম্বই, ভাইজ্যাগ, চেন্নাইয়ে মছলিখোর বাঙালির দীর্ঘশ্বাস পড়ে! অভিজ্ঞরা বলেন, দিঘার স্যান্ড লবস্টার মোটেও পদের নয়। রক লবস্টার (সমুদ্রের ধারে পাথরে নিবাস) এ তল্লাটে কদাচিত্‌ দেখা গেলেও তার গোখরো সাপের মতো প্রকাণ্ড মাথাটা দেখে ভুলবেন না। অত বড় চেহারায় খাওয়ার মতো মাংস সামান্য। অতএব কিছু বিশ্বস্ত সাপ্লায়ার ছাড়া ভরসা নেই।
পাঁচতারা হোটেলের বাইরে এ শহরে নিয়মিত লবস্টার সরবরাহ করে চলে যারা তাদের নাম চারকোল গ্রিল। চার নম্বর ব্রিজের কাছে সেখানকার গার্লিক বাটার পেপার লবস্টার-স্বাদ জিবে লেগে আছে। খোলসুদ্ধ পাতে সাজানো হয়েছিল। মাংসটা বার করে গ্রেভিতে দিয়ে। গার্লিক বাটার পেপার পদটি একটি আশ্চর্য সৃষ্টি। সম্ভবত মুম্বইয়ের মহেশ লাঞ্চহোম বা তৃষ্ণার মতো সি-ফুড বিশেষজ্ঞ কোনও রেস্তোরাঁর প্রেরণায় এই রেসিপি কলকাতায় ঢুকেছে। ভারতীয় মশলাদার আমেজ ও মাখনের মিশেল নিয়ে কথা হবে না! ম্যাঙ্গালোরে সুলভ পাতলা ফিনফিনেতম রুমালের মতো ‘নির দোসা’র সঙ্গতে এই লবস্টার দুরন্ত। সেটা আন্দামানের আমদানি বলে তখন শুনেছিলাম।
নবজাতক ফিশ ফিশ এ বার জবরদস্ত সাহসের স্বাক্ষর রেখেছে। কলকাতায় এই বচ্ছরকার সময়টায় দেড় মাস ধরে লবস্টার-উত্‌সব চাট্টিখানি কথা নয়। দুই কর্তা অনিরুদ্ধ গুহরায় ও শেফ দেবাশিস কুণ্ডু ইতিমধ্যে মাংসকে ঢুকতে না দিয়ে স্রেফ মেছো পদের রেস্তোরাঁ খুলেই তাক লাগিয়েছিলেন। কলকাতাকে এত দিন টানা লবস্টার খাওয়ানোটাও অতি মহত্‌ কাজ। ফিশফিশে ফিসফিস, এ লবস্টার না কি দক্ষিণ-পুব এশিয়ার। সে যা-ই হোক, ডান হাতের কাজের সময়ে অত খুঁটিনাটি ভাবনার মানে হয় না।
শেফ দেবাশিস ১১ রকমের লবস্টার পেশ করেছেন। এই লবস্টার একাদশে বার্বিকিউ সসের পদটিই বছর শেষের মেহফিলে সব থেকে জাঁকালো বলে মনে হয়েছে। তবে ঈষত্‌ চটপটে সিঙ্গাপুরিয়ান লবস্টারও নির্ঘাত বাঙালির মুখে রুচবে। রক্ষণশীল বাঙালির কথা ভেবেই সিঙ্গাপুরের রীতিতে শুকনো চিংড়ি-টিংড়ির (শ্রিম্পপেস্ট) প্রাবল্য নেই। হলুদমাখা কাইয়ের সঙ্গতে জুকিনি ব্রকোলি, বেবিকর্ন, বেল পেপারস। মশলাদার স্বাদ অটুট রেখে লবস্টারের হাই ক্যালরির সঙ্গে এই সব্জির ভারসাম্যটা স্বাগত। যেমন, চিনে শৈলির স্টার ফ্রায়েড লবস্টার। সয়া ও তিলের তেলের স্বাদটা দারুণ লাগে। লবস্টারের সঙ্গে ব্যালেন্স করে বড় বড় পাকচয়ের পাতা চিবোতেও বেশ!
লবস্টারের রিসোতোয় দেবাশিসের হাতের ব্রাউন বাটারও দারুণ। মাখনের সঙ্গে ভিনিগার মিশিয়ে হেঁসেলেই প্রস্তুত করা হয়েছে। জিভের টাকরায় এই মাখনের হাল্কা ধাক্কা মারার অভ্যেসটা বড়ই মধুর। মেক্সিকান সুগন্ধী লঙ্কার সঙ্গে ঝাল-ঝাল চিলি লবস্টার আছে। আর একটি ঝাল-ঝাল লবস্টার হয়েছে তুলসীপাতাযোগে। “এ হল কৃষ্ণ তুলসীপাতা। একটু ঝাল-ঝাল” দেবাশিস শোনালেন। তন্দুরির প্রতি একনিষ্ঠরাও বঞ্চিত নন। তন্দুরি চিকেনের বদলে তন্দুরি লবস্টার ফরমায়েশ করতে পারেন তাঁরা। চিজ-ক্রিমযোগে কন্টিনেন্টাল বেক্ড রান্নার যাঁরা ভক্ত, তাঁদের জন্যও কিছু লবস্টার পদ আছে। মোদ্দা কথা, এই গঙ্গাপারের দেশে লবস্টারকে প্রতিষ্ঠা করার এই চেষ্টাটুকু কুর্নিশ না-করে উপায় নেই।

মেনুর হিট
লবস্টার (না পেলে গলদা) ইন বার্বিকিউ সস
উপকরণ

এক কিলো লবস্টার বা ১২-১৫টা গলদা চিংড়ি
দু’টেবল চামচ রেড চিলিপেস্ট
এক টেবল চামচ আদা-রসুনবাটা
এক টেবল চামচ ক্যাপসিকো সস
দু’টেবল চামচ টমেটো সস
এক টেবল চামচ উস্টার সস
আধ চা-চামচ ডার্ক সয়া সস
এক টেবল চামচ নামপ্লা সস
আধ চা-চামচ কালো মরিচগুঁড়ো
ধনেপাতার দু’টো ডাঁটি
নুন-চিনি স্বাদমতো
একটু ব্র্যান্ডি, লেবুর রস।
সঙ্গে নানা রঙের ক্যাপসিকাম,
পেঁয়াজ, মাশরুমও চলবে।
প্রণালী

যাবতীয় মশলা, ব্র্যান্ডি, লেবুটেবু দিয়ে মাছটা ৫-৭ মিনিট ম্যারিনেট করুন।
প্যানে নেড়েচেড়ে নিন।
একটু সব্জি-টব্জিও এক সঙ্গে নেড়েচেড়ে রাঁধুন।
এ বার মাছে মাখানো রসটার বাকি অংশটুকু আর একটু ব্র্যান্ডি ঢেলে প্যানে নেড়েচেড়ে পুড়িয়ে নিন।
এই বার্বিকিউ সস দিয়ে লবস্টার/গলদা খেতে বেশ লাগবে।

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.