ব্যাগ গুছিয়ে...
পিকচার পোস্টকার্ডে স্বাগত
খানে মেঘ গাভীর মতো চরে। সূর্যের আলো মরে এলে চারপাশের প্রকৃতি হয়ে ওঠে মায়াবি। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধূ ধূ প্রান্তর জুড়ে নেমে আসে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।
‘ওয়েলকাম টু সিমলা’। বিশালবপু বাসটা পাহাড়ের বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়ল বোর্ডটা। নতুন অতিথিদের স্বাগত জানাতে তৈরি এই শৈলশহর। মনে মনে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, বেড়ানোটা সত্যিই শুরু হল তা হলে! পুজোর ছুটির আনন্দে গোটা কলকাতা যখন মশগুল, সে সময়েই ব্যাগ-স্যুটকেস বেঁধে চেপে বসেছিলাম কালকা মেলে। দেড় দিনের ট্রেন-সফর শেষে প্রথম থামা চণ্ডীগড়ে। চণ্ডীগড় শহরে যখন পা রাখলাম, ঘড়িতে রাত সাড়ে ৩টে। স্টেশনে ঘণ্টা দু’য়েক কাটানোর পরে বাস ছাড়ল সাড়ে ৫টা নাগাদ। পূবের আকাশ তখন একটু একটু করে ফরসা হতে শুরু করেছে। ঘণ্টা পাঁচেকের পথ সিমলা। ছিমছাম, ছবির মতো শহরটাকে পাশে রেখে ঝকঝকে রাস্তা দিয়ে ছুটে চলা। শহরের সীমানা শেষ হতেই এক লহমায় প্রকৃতির রূপ গেল বদলে। পাকদণ্ডী দিয়ে উঠতে উঠতে একপাশে রুক্ষ পাহাড়, অন্য পাশে শ’খানেক ফুট নীচে সবুজ উপত্যকা। মাঝেমধ্যেই দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে নেমে এসেছে ঝরনার ধারা। সিমলা শহরে ঢোকার আগে পথে পড়ল আরও কয়েকটি ছোট শহর। চারপাশের দোকানপাট, বাসিন্দাদের ভিড়ে সেখানে তখন পুরোমাত্রায় দিন শুরু হয়ে গিয়েছে। যাই হোক, খানিকটা পাহাড় দর্শন করে সিমলার সঙ্গে যখন আমাদের পরিচয় হল, তখন বেশ বেলা। অক্টোবরের শেষেও রীতিমতো ঘাম হচ্ছে। হোটেলের ঘরে পৌঁছতেই হাতে এসে গেল গরমাগরম জিলিপি। খিদের মুখে তা যেন অমৃত। দুপুরে পুরোদস্তুর বাঙালি খানা। খাওয়াদাওয়া সেরে একটু জিরিয়ে নেওয়ার ফাঁকে ঝটিতি ঠিক করে ফেলা, বিকেলবেলা বেড়ানোর ছক।
হোটেল মালিকই কথা প্রসঙ্গে জানালেন, সিমলার প্রসিদ্ধ কালীবাড়ি এবং ম্যাল দুটোই হোটেল থেকে মিনিট দশেকের পথ। প্রথম গন্তব্য সিমলা কালীবাড়ি। এক আশ্চর্য শান্তির পরিবেশ সারা মন্দির জুড়ে। এখানে রয়েছে কম খরচে ভ্রমণার্থীদের থাকার সুবন্দোবস্ত। কালীবাড়ি থেকে ম্যাল যাওয়ার রাস্তা দীর্ঘ চড়াই। তবে, যাওয়ার জন্য রয়েছে লিফ্টও। প্রায় পড়ন্ত বিকেলে পৌঁছলাম ম্যালে। দু’পাশে হরেক কিসিমের দোকান, মাঝখান দিয়ে প্রশস্ত রাস্তা। সপ্তাহান্তের বিকেলে ম্যালে তখন পা ফেলার জায়গা প্রায় নেই। রাস্তার ধারে বেঞ্চে বসে, কফিতে চুমুক দিয়ে আড্ডা মেরে কেটে যাবে সারা সন্ধেটা। চাইলে করা যেতে পারে টুকটাক উইন্ডো শপিংও। হোটেলে ফিরে হাল্কা স্ন্যাক্স খেয়ে তড়িঘড়ি ডায়েরি-পেন নিয়ে বসা পরের দিনের প্রোগ্রাম ঠিক করতে। আগে থেকেই ঠিক ছিল, সিমলা ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনে যাওয়া হবে ভাইসরয় প্যালেস এবং আর্মি মিউজিয়াম। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। ভাইসরয় প্রাসাদ দেখতে গিয়ে বুঝলাম, এটা না ঘোরা হলে সিমলা ভ্রমণ অসম্পূর্ণ। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে এটি ছিল রাষ্ট্রপতির নিবাস। বর্তমান নাম ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজ। ১২৪ বছরের পুরনো ব্রিটিশ আমলের এই প্রাসাদ রাজকীয় মহিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সবটুকু ঐতিহ্য নিয়ে। ভিতরের একটি অংশ জনসাধারণের জন্য খোলা। স্থানীয় গাইড ঘুরিয়ে দেখালেন ভবনের বিভিন্ন অংশে কাঠের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কারুকাজ, লাইব্রেরি, সেমিনার রুম এবং ফটো গ্যালারি। সযত্নে রক্ষিত আছে ‘ভাইসরিগ্যাল চেয়ার’ এবং ‘গ্র্যান্ডমাদার্স ক্লক’। প্রাসাদের সামনে সবুজ ঘাসে ঢাকা লন, আর এক দিকে সুসজ্জিত স্যুভেনির-কাম-কফি শপ। সেখানে মিলবে বিভিন্ন বিষয়ের বই, মেমেন্টো থেকে শুরু করে ছোটখাটো ঘর সাজানোর জিনিস, এমনকী টি-শার্টও। এক-দেড় ঘণ্টা ঘোরার ফাঁকে কোথা দিয়ে যে সময় চলে যাবে, টেরই পাওয়া যাবে না। সব দেখার পরে আপনা থেকেই মনে হচ্ছিল, আহা, এমন জায়গায় থাকতে কার না ইচ্ছে করে!
ভাইসরয় প্যালেস ঘুরে এ বার আর্মি মিউজিয়াম। সেখানে অন্য এক জগত্‌। বিভিন্ন ঘরে সাজানো সেনাবাহিনীর পোশাক-আশাক, অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধবিমানের মডেল। দেওয়াল জুড়ে শোভা পাচ্ছে পদক, মেডেল, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাস আরও কত কী। ওই রকম ছোট পরিসরে যে ভুলভুলাইয়ার মতো এত ঘর থাকতে পারে এমন বিবিধ জিনিসের সম্ভার নিয়ে, না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। চাইলে সিমলা থেকে সারা দিনের জন্য ঘুরে আসা যেতে পারে কুলু ভ্যালিও। হাল্কা শীত গায়ে মেখে ঘুরে নেওয়া যেতে পারে জমজমাট মেলা।
সিমলায় আমাদের জন্য বরাদ্দ মাত্র দু’টি দিন। অগত্যা বিধি বাম। কী আর করা! তৃতীয় দিনই ফের তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাসে চাপা। এ বার মানালি। দু’ধারের নিসর্গশোভা উপভোগ করতে করতে সারা দিন ধরে চলা। ঘণ্টা আটেকের রাস্তা। পথেই সারা হল প্রাতরাশ এবং দুপুরের খাওয়া। মাঝে পার হলাম শতদ্রু নদী। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে সে-ও চলেছে অজানা গন্তব্যের দিকে। মানালি পৌঁছলাম যখন, সন্ধে হব-হব। বাস থেকে নামতেই উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল কনকনে হিমেল হাওয়া। সহযাত্রীদের কেউ কেউ সহাস্য মন্তব্য করলেন, ‘সোয়েটার-মাফলার-মাঙ্কি ক্যাপ আনা তা হলে সার্থক, কী বলেন দাদা?’ ঘরে ঢুকে ক্ষণিক বিশ্রামের পরে জলখাবারে মিলল পকোড়া আর ধোঁয়া-ওঠা চা। সব সেরে রাতের খাবার খেয়ে শরীর যখন কম্বলে ঢাকল, ঘড়ির কাঁটা ১১টা ছুঁইছুঁই।
পর দিন ভোরে বারান্দায় হিমেল হাওয়ার পরশ নিতে এসে চোখে পড়ল অনির্বচনীয় এক দৃশ্য। পাহাড়চূড়ায় ঝকঝকে বরফের উপরে রামধনুর সাত রঙের খেলা। ঠিক তার উল্টো দিকে পাইনগাছের ঘন সারি। আর এই দুইয়ের মাঝখান দিয়ে প্রবল গর্জনে বয়ে চলেছে বিয়াস অর্থাত্‌ বিপাশা নদী। পাথরে-পাথরে ধাক্কা খেয়েও চলার বিরাম নেই তার। তাকে সঙ্গী করে ঘোরা শুরু হল আমাদেরও। প্রথমে যাওয়া হাদিম্বা মন্দির। জনশ্রুতি, এখানে হিড়িম্বা শ্রীরামচন্দ্রের তপস্যা করেছিলেন। জঙ্গল-ঘেরা পাহাড়ের কোলে এই মন্দিরে ইতিহাস যেন কথা বলে। ঘোরা যেতে পারে জাখু মন্দির। সেই মন্দিরের ভিতরে পুরো অংশ জুড়ে কাঠখোদাই করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সব দেবদেবীর মূর্তি। ফেরার পথে ঘণ্টাখানেক থামা ম্যাল-এ। কী আশ্চর্য! আলো-ঝলমল মানালির ম্যালে যেন উঠে এসেছে একটুকরো চৌরঙ্গি। চতুর্দিকে শুধু বাঙালি পর্যটক, দোকানদারের হাঁকডাক আর শীতপোশাকের দোকানগুলিতে উপচে পড়া ভিড়। ঠিক যেন রবিবারের সন্ধ্যার কলকাতা।
এর মধ্যেই মাস-তারিখের হিসেব গুলিয়ে দিয়ে কোথা দিয়ে যেন কেটে গিয়েছে এক সপ্তাহ। আমাদের পরের গন্তব্য রোটাং পাস। মানালি থেকে ৫৮ কিলোমিটার। যাওয়ার রাস্তা কখনও মসৃণ, কখনও আবার ভাঙাচোরা। সোয়েটার-জ্যাকেট-উলের মোজা-গ্লাভ্স আর টুপি চাপিয়ে, কার্যত এস্কিমোদের বেশে যখন স্নো-পয়েন্টে পৌঁছলাম, সত্যিই মনে হল এক অন্য পৃথিবীতে এসেছি। চারপাশে আমাদের ঘেরাও করে রেখেছে আকাশছোঁয়া পাহাড়। বরফে সূর্যের আলো পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার জোগাড়। একপাশে পাহাড়ের বুক চিরে চলে গিয়েছে লাদাখ যাওয়ার রাস্তা। স্নো-পয়েন্টে কাটল প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট। নামার পথে গাড়ি থেকেই দেখা যাচ্ছিল সাপের মতো আঁকাবাকা রাস্তা। কোনও শিল্পী যেন তুলি দিয়ে এঁকে রেখেছেন। সব মিলিয়ে এক পারফেক্ট ফটোফ্রেম।
প্রকৃতির বৈপরীত্য মনে হয় মানালি এলেই বোঝা যায়। পাহাড়ের অপরূপ রূপের পাশাপাশি দেখা মিলবে উষ্ণ প্রস্রবণেরও। তা চাক্ষুষ করতে যেতে হবে মণিকরণ। মানালি থেকে ৮৩ কিলোমিটার দূরে, পার্বতী নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই শহরে আছে পবিত্র এক গুরুদ্বার। সারা দেশ থেকে অগণিত শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষ ছুটে আসেন এর টানে। গুরুদ্বারের ভিতরে যে লঙ্গরখানা, তার দরজা খোলা সর্বসাধারণের জন্য।
দেখতে দেখতে শেষ হয়ে এল আমাদের সিমলা ভ্রমণ। মন না চাইলেও একসময় তো বলতেই হয়, ‘অলবিদা’। সারা পাহাড় তখন একসুরে বলতে থাকে, ‘আবার এস বন্ধু!’

কী ভাবে যাবেন
ট্রেনে হাওড়া থেকে কালকা বা চণ্ডীগড়। কালকা থেকে সিমলা যাওয়ার জন্য
রয়েছে ন্যারোগেজের ট্রেন। সড়কপথে দূরত্ব ১১৭ কিমি। বাস বা গাড়িতে ঘণ্টা পাঁচেকের রাস্তা।
অথবা বিমানে কলকাতা থেকে চণ্ডীগড়। সেখান থেকে বাস বা গাড়িতে।
কোথায় থাকবেন
হিমাচল প্রদেশ পর্যটনের অতিথিশালা ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য বেসরকারি হোটেল এবং রিসর্ট।
কখন যাবেন
বর্ষাকাল ছাড়া সব সময়েই যাওয়া যায়। তবে ভাল সময় নভেম্বর থেকে মার্চ।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.