পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডে চার্জ গঠন হল না ১১ মাসেও
দিল্লির ধর্ষণ-কাণ্ডের দ্রুত বিচার ও দোষীদের কঠোরতম শাস্তির দাবিতে দেশ জুড়ে যখন আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, তখন প্রায় বছর গড়ালেও কলকাতার পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া গতি পায়নি। তামাম দেশে সাড়া জাগানো ওই ঘটনাটির চার্জশিট জমা পড়েছে ছ’মাস হয়ে গেল। কিন্তু এখনও চার্জ গঠন করা যায়নি। তাই শুরু হয়নি মূল মামলার বিচার। এমনকী, মূল অভিযুক্তও ধরা পড়েনি।
ফলে যারপরনাই নিরাশ পার্ক স্ট্রিটের অভিযোগকারিণী। তিনি বলছেন, “বছর ঘুরে গেলেও মূল মামলার বিচারের কাজ শুরু হল না! আমি হতাশ।” তাঁর এ-ও আক্ষেপ, “আমি হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছি, এটাই বোধহয় ঘটনার গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে! দিল্লির মেয়েটির মতো আমিও যদি ভেন্টিলেটরে পড়ে থাকতাম, তা হলে হয়তো এত দেরি হতো না।” মহিলা চাইছেন, দিল্লির ঘটনাটির মতো তাঁর অভিযোগেরও বিচার হোক ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে।
চার্জ গঠন এখনও হল না কেন?
পার্ক স্ট্রিট মামলায় যুক্ত আইনজীবী ও পুলিশের একাংশের বক্তব্য: মূল অভিযুক্ত কাদের খানকে ধরা না-গেলেও ধৃত অন্য তিন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট সময়েই চার্জশিট পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রক্রিয়াগত নানা কারণে চার্জ গঠন করা যাচ্ছে না বলে এই মহলের দাবি। “অভিযুক্তপক্ষ পিটিশন দাখিল করছে কোর্টে। তার নিষ্পত্তি করতে গিয়েই চার্জ গঠন পিছোচ্ছে।” মন্তব্য এক কৌঁসুলির।
শাস্তি চাই। দিল্লি গণধর্ষণ কাণ্ডের প্রতিবাদে সল্টলেকে মোমবাতি মিছিল। তবে প্রায় এক বছর হয়ে
গেলেও কলকাতার পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডে মূল মামলার বিচার শুরু হয়নি। হতাশ অভিযোগকারিণী
ফাস্ট ট্র্যাক আদালতে বিচারের দাবি জানিয়েছেন।—নিজস্ব চিত্র
৫ ফেব্রুয়ারি রাতে পার্ক স্ট্রিটের এক পাঁচতারা হোটেলের সামনে ওই মহিলাকে গাড়িতে তুলে নিয়েছিল কয়েকটি যুবক। অভিযোগ, গাড়িতেই গণধর্ষণ ও মারধর করে তাঁকে রবীন্দ্র সদনের কাছে ফেলে দিয়ে যাওয়া হয়। মহিলা পরে অভিযোগ জানাতে পার্ক স্ট্রিট থানায় গেলে সেখানেও তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অশালীন আচরণ করা হয়েছিল, যার জন্য দোষী অফিসারদের শাস্তিও দিয়েছেন লালবাজার কর্তৃপক্ষ। ধর্ষণের ঘটনাটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরে শোরগোল শুরু হয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোটা ব্যাপারটিকে ‘সাজানো’ বলে অভিহিত করলেও কলকাতা পুলিশ গণধর্ষণের অভিযোগে নাসির খান, নিশাত আলম ওরফে রুমান খান ও সুমিত বজাজকে গ্রেফতার করে। বাজেয়াপ্ত করা হয় গাড়িটিও।
এর পরেই লালবাজার থেকে বদলি করা হয় মামলাটির তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত তদানীন্তন গোয়েন্দা-প্রধান দময়ন্তী সেনকে। মূল অভিযুক্ত কাদের এখনও অধরা। গত মে মাসে পুলিশ মামলার চার্জশিট জমা দিয়েছে। কিন্তু ডিসেম্বরের শেষে এসেও চার্জ গঠন করা যায়নি। পুলিশ-সূত্রের খবর: অভিযোগকারিণীর দেহরস-সহ বিভিন্ন নমুনা ফরেন্সিক পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছিল। হোটেলের ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি)-এর ফুটেজ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় চারটি হার্ড ডিস্কও। তাতে ৫ ফেব্রুয়ারি রাত ন’টা থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি ভোর চারটে পর্যন্ত সাত ঘণ্টায় কী কী ছবি ধরা পড়েছে, তা জানতে চেয়েছিলেন তদন্তকারীরা। কিন্তু কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি (সিএফএসএল) তার রিপোর্টে বলেছে, হার্ড ডিস্কের ব্যবহৃত অংশে (অ্যালোকেটেড স্পেস) আপাত ভাবে যে সব ছবি দেখা যাচ্ছে, সেগুলো নির্দিষ্ট ওই সাত ঘণ্টার নয়। হার্ড ডিস্কের বাকি অংশ (আনঅ্যালোকেটেড স্পেস) অবশ্য প্রযুক্তিগত কারণে পরীক্ষা করা যায়নি বলে ফরেন্সিক-রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি জানানো হয়েছে, পুলিশ ধর্ষিতার দেহরসের যে নমুনা ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠিয়েছিল, তাতে ধৃতদের বীর্যের কোনও অস্তিত্ব মেলেনি। চুলের নমুনাতেও পাওয়া যায়নি রক্তের চিহ্ন।
ফরেন্সিকের এ হেন রিপোর্ট স্বভাবতই বিবাদিপক্ষের কাছে অন্যতম হাতিয়ার। অভিযুক্তপক্ষের দুই কৌঁসুলি জাকির হোসেন ও তপেশ ভট্টাচার্যের কথায়, “পুলিশ যা অভিযোগ এনেছে, সিসিটিভি-ফুটেজেও তার প্রমাণ নেই। আদালতের কাছে ফুটেজ চেয়েছি।” কিন্তু সিসিটিভি-তে ওই সময়সীমার ছবি পাওয়া গেল না কেন?
পুলিশ ও ফরেন্সিক-সূত্রের ব্যাখ্যা: হোটেলের সিসিটিভি-র ফুটেজ কয়েক দিন অন্তর স্বয়ংক্রিয় ভাবে মুছে যায়, অথবা পরবর্তী সময়ের ছবি তার উপরে চেপে (ওভারল্যাপ) বসে। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ওই সাত ঘণ্টার রেকর্ডিং মুছে গিয়েছে, নাকি অন্য ছবি তার উপরে চেপে গিয়েছে, তা এখনও জানা যায়নি। তবে সাইবার-বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, কোনও রেকর্ডিং মুছে গেলেও সংশ্লিষ্ট হার্ড ডিস্কের অব্যবহৃত অংশে (অর্থাৎ আনঅ্যালোকেটেড স্পেসে) তার ‘ব্যাক আপ’ থাকতে পারে। সেটা উদ্ধার করা সম্ভব, মনে করছেন ওঁরা ।
ফরেন্সিক-রিপোর্ট তেমন অনুকূল না-হলেও পার্ক স্ট্রিট মামলায় সরকারিপক্ষ এখনও আশা ছাড়েনি। সরকারপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি সর্বাণী রায়ের দাবি, “এতে অসুবিধে হবে না। আমাদের হাতে অন্যান্য তথ্য-প্রমাণ রয়েছে।” একই দাবি লালবাজারের এক পুলিশ-কর্তার, যিনি বলছেন, “পার্ক স্ট্রিট থানার প্রথম যে অফিসার হোটেলে তদন্ত করতে গিয়েছিলেন, তিনি সিসিটিভি-র ফুটেজ পেন ড্রাইভে তুলে নেন। তা দেখেই অভিযোগকারিণী ধৃতদের শনাক্ত করেছেন।” তা হলে হার্ড ডিস্ক ফুটেজের দরকার পড়ল কেন?
পুলিশ-সূত্রের খবর: পেন ড্রাইভের ওই ‘কপি’ করা ছবি আদালতে এখনও গ্রাহ্য নয়। সিসিটিভি-ক্যামেরায় ধরা পড়া মূল ফুটেজকেই প্রমাণ হিসেবে গণ্য করবে কোর্ট। তাই হার্ড ডিস্ক পরীক্ষার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
এমনই নানাবিধ কারণে গতি হারিয়েছে পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া। “গোড়ায় পুলিশ-প্রশাসন নড়ে-চড়ে বসেছিল। আবার সব থিতিয়ে গিয়েছে।” এগারো মাস পরে খেদ করছেন অভিযোগকারিণী।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.