|
|
|
|
স্কুলই শেষ কথা, অবশেষে কবুল সংসদের |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
রাতারাতি সুর বদলে ফেলল উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ। জানিয়ে দিল, নিজেদের পরীক্ষায় স্কুলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
মঙ্গলবার সংসদ বলেছিল, সন্তোষপুরের ঋষি অরবিন্দ বালিকা বিদ্যাপীঠে উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্টে ফেল করা এবং গ্রেস নম্বর পেয়ে পাশ করার ছাত্রীদের আবার পরীক্ষা নিতে হবে। সংসদের উপসচিব (পরীক্ষা) মলয় রায় এমনও দাবি করেন, তাঁদের নির্দেশ মানতে বাধ্য থাকবে স্কুল।
কিন্তু ফেল করা-দের পাশ করানোর দাবিতে রাতভর শিক্ষিকাদের ঘেরাও করে রাখা ছাত্রীদের সামনে এ ভাবে কার্যত মাথা ঝুঁকিয়ে সংসদ ঠিক করেনি বলেই মত দিয়েছিলেন শিক্ষাবিদদের বড় অংশ। তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, এর পর স্কুলে স্কুলে পাশ করানোর দাবিতে বিক্ষোভ দেখানোর হিড়িক পড়ে যাবে। সেই আশঙ্কাকে সত্যি করে মঙ্গলবারের পর এ দিনও রাজ্যের একাধিক স্কুলে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু অবশ্য মঙ্গলবারই সংসদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, সংসদ বড়জোর কোনও অনুরোধ করতে পারে। কিন্তু স্কুলকে কোনও নির্দেশ পাঠানোর এক্তিয়ার তাদের নেই। বুধবার সংসদ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তিনি এ নিয়ে কথা বলবেন বলেও জানিয়েছিলেন। স্কুলশিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, বুধবার সকালেই সংসদ সভাপতিকে অবস্থান পরিবর্তন করে স্কুলের স্বাধিকারের পক্ষে বয়ান দেওয়ার নির্দেশ দেন ব্রাত্য বসু। রাজ্য সরকারের চাপের মুখেই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সংসদ সুর বদল করে বলে সূত্রের খবর। সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে সংসদ সভাপতি মুক্তিনাথ চট্টোপাধ্যায় এ দিন জানিয়ে দেন, নিজেদের পরীক্ষায় স্কুলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্টের ক্ষেত্রেও তা-ই।
সংসদ এ দিন স্পষ্ট করে জানিয়েছে দাবি আদায়ে স্কুলে ঘেরাও-বিক্ষোভ কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।
• নিজেদের পরীক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এই ব্যাপারে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের কিছু করণীয় নেই।
• ছাত্রছাত্রীদের অভাব-অভিযোগ থাকলে রীতি-নীতি মেনে তারা স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারে।
• শিক্ষক-শিক্ষিকারা যদি মনে করেন, তাঁদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অবকাশ রয়েছে, কেবল তখনই পড়ুয়াদের কথা ভেবে, তা করতে পারেন। |
অসংসদীয় সংসদ |
উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের কাজ কী?
• মূলত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলপ্রকাশ ও ওই স্তরের পাঠক্রম তৈরি করা।
স্কুলের পরীক্ষায় সংসদের ভূমিকা কী?
• সংসদের আইন অনুসারে কোনও ভূমিকা নেই।
সন্তোষপুরের স্কুলে সংসদ গেল কেন?
• স্কুল কর্তৃপক্ষ সমস্যার কথা জানিয়েছিলেন।
স্কুল চাইলেও কি সংসদের যাওয়া উচিত ছিল?
• মোটেই নয়, এটা সংসদের কাজ নয়।
তা হলে কেন গেলেন সংসদের প্রতিনিধিরা?
• মন্ত্রীর নির্দেশে, দাবি সংসদ কর্তাদের।
কেন এমন নির্দেশ দিলেন মন্ত্রী?
• মন্ত্রীর দাবি, ওঁরা লিখিত ভাবে পুলিশের সাহায্য নিতে চাননি। তাই ঘেরাওমুক্ত করতে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু পরীক্ষার খাতা ও ট্যাবুলেশন শিট আনা হল কেন?
• মন্ত্রীর দাবি, তিনি এমন নির্দেশ দেননি। সংসদের দাবি, পরিস্থিতির চাপে এমনটা করতে হয়েছে।
সংসদের অনধিকার প্রবেশের ফল কী?
• স্কুলে স্কুলে ছড়িয়ে পড়ল পাশের দাবিতে ফেল করাদের বিক্ষোভ।
শেষ পর্যন্ত কি সংসদ বুঝতে পারল?
• হ্যাঁ। তারা জানাল, পরীক্ষায় স্কুলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। |
|
সংসদের পক্ষ থেকে এ কথাও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, এই আর্জি কেবল সন্তোষপুরের ওই স্কুলটির জন্য নয়। গোটা রাজ্যের সব স্কুলের পড়ুয়াদের জন্যই তা প্রযোজ্য। কিন্তু তার আগেই মঙ্গলবারের মতো এ দিনও সকাল থেকে বিভিন্ন স্কুলে একই রকম দাবিতে অশান্তি শুরু হয়। সিঁথির কস্তুরবা কন্যা বিদ্যাপীঠে এক দল ছাত্রী বাইরে থেকে কোলাপসিবল গেটে তালা লাগিয়ে দেন। শিক্ষিকারা আটকে পড়েন। পুলিশের ধমক খেয়ে তালা খোলেন ছাত্রীরা। মুর্শিদাবাদের সেখালিপুর হাইস্কুল, কালনার কৃষ্ণদেবপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে বিক্ষোভ চলে। কালনার স্কুলটিতে পরিস্থিতির চাপে ফেল করাদেরও পাশ করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু মুশির্দাবাদের স্কুলটিতে কর্তৃপক্ষ নতি স্বীকার করেননি। শেষে বিক্ষোভকারীরাই রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হন। আসানসোলের মণিমালা বালিকা বিদ্যালয়েও একই ঘটনা ঘটেছে।
সংসদ সভাপতি এ দিন বলে দিয়েছেন, “শিক্ষামন্ত্রীর পরামর্শে সংসদ নিজের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেছে। স্কুলের স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ করার কোনও উদ্দেশ্য নেই। তবে ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে স্কুলের কাছে অনুরোধ, তাঁরা প্রয়োজনে নিজেদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে পারেন।”
ঋষি অরবিন্দ বালিকা বিদ্যাপীঠে অন্তত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সুযোগ নেই এ দিন সন্ধ্যাতেই প্রধান শিক্ষিকা শ্রীমতী ঘোষ তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “সংসদ যদি বাইরের শিক্ষকদের দিয়ে খাতা দেখায়, অকৃতকার্যদের সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। কারণ, শিক্ষিকারা সব দিক বিবেচনা করে, অনেক সহৃদয়তার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।” আর এই ভাবে পরীক্ষার ফল পুনর্বিবেচনা করা হলে ভবিষ্যতে স্থায়ী সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে বলেও এ দিন মন্তব্য করেছেন শ্রীমতিদেবী। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, “সে দিন হয়তো আমি প্রধান শিক্ষিকা থাকব না, মুক্তিনাথবাবু সভাপতি থাকবেন না। কিন্তু সমস্যাটা থেকে যাবে।”
সমস্যা মেটানোর দায়িত্ব স্কুল কর্তৃপক্ষের উপরে না ছেড়ে, কেন সংসদ কর্তারা ট্যাবুলেশনের কাগজপত্র এবং টেস্টের খাতা নিয়ে এলেন, তা নিয়ে সংসদের আধিকারিকদের একাংশের মধ্যেও ধন্দ রয়েছে। সংসদ সভাপতির পদত্যাগ দাবি করে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে আরএসপি-র ছাত্র সংগঠন পিএসইউ। বুধবার সংসদ কর্তারা নিজেদের কাজের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, “স্কুলে খাতা অক্ষত না-ও থাকতে পারে বলে অভিযোগ উঠেছিল। তাই, স্কুলকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে খাতা সংসদে নিয়ে আসা হয়। সেগুলি স্কুলে ফেরত পাঠানো হবে।” শ্রীমতীদেবী জানান, এ দিন সংসদের পক্ষ থেকে তাঁদের স্কুলের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করা হয়নি। তিনি বলেন, “ছাত্রীরা বারবার স্কুলে এসে পরিস্থিতি সম্পর্কে আন্দাজ পেতে চেয়েছে। কিন্তু সংসদ কিছু না বলায় আমরাও ছাত্রীদের স্পষ্ট করে কিছু জানাতে পারিনি।” সংসদ সভাপতি অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, আজ, বৃহস্পতিবার দুপুরের মধ্যে সংসদের বক্তব্য এবং নিয়ে আসা টেস্টের খাতা স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। |
বিক্ষোভ-নামা |
বুধবার |
|
মঙ্গলবার |
কস্তুরবা কন্যা বিদ্যাপীঠ
সিঁথি, কলকাতা
কালনা কৃষ্ণদেবপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়
কালনা, বর্ধমান
সেখালিপুর হাইস্কুল,
লালগোলা, মুর্শিদাবাদ
মণিমালা বালিকা বিদ্যালয়
আসানসোল, বর্ধমান |
ঋষি অরবিন্দ বালিকা
বিদ্যাপীঠ
সন্তোষপুর, কলকাতা
জগৎপুর রুক্মিণী বিদ্যামন্দির
ফর বয়েজ
বেহালা, কলকাতা
অন্নদাসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়
বাগুইআটি, কলকাতা |
|
গ্রেস দেওয়ার ব্যাপারে মঙ্গলবার স্কুলের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ এনেছিলেন সংসদ কর্তৃপক্ষ। বুধবার তার জবাবে শ্রীমতি দেবী বলেন, “বাংলা পরীক্ষা দেওয়ার সময় এক ছাত্রী অসদুপায় নিয়েছিল বলে জানতে পারি। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।” কিন্তু তাঁর দাবি, ওই ছাত্রীর অন্যান্য বিষয়ের নম্বর যথেষ্ট ভাল থাকায় শিক্ষিকাদের সঙ্গে কথা বলেই ছাত্রীটিকে টেস্টে পাশ করানো হয়েছে। প্রধান শিক্ষিকা এ দিন সংসদ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, “ছাত্রীদের সামনেই ওঁরা ফলাফলে অসঙ্গতির কথা বলেন। গত দু’দিন ধরে দেখছি, আমাদের নামে এক তরফা বলা হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের কথা জানালাম।” মুক্তিনাথবাবু এই প্রসঙ্গে বলেন, “সংসদের কারও কথায় যদি কেউ আহত বা অপমানিত হয়ে থাকেন, তা হলে আমি ব্যক্তিগত ভাবে মার্জনা চাইছি।”
তবে এ দিনের সাংবাদিক সম্মেলনেও ভেঙে না মচকানোর চেষ্টা করেছেন সংসদ সভাপতি। নিজেদের কাজের সপক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, “ট্যাবুলেশনের কাগজপত্রে যে সব অস্বচ্ছতা ও অসঙ্গতি ধরা পড়েছে, স্কুলের কাছে সে সম্বন্ধে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। আগামী শুক্রবারের মধ্যে এই ঘটনা নিয়ে স্কুলশিক্ষা দফতরে রিপোর্ট জমা দেবে সংসদ।” |
|
|
|
|
|