মতিরাম ক্লাস সেভেনে পড়ে। তার অঙ্কে ভীষণ ভয়। অঙ্কের ক্লাস শুরু হলেই পেট গুড়গুড় করে, মাথা ঝিমঝিম করে। চোখেও অনেক রকম লাল-নীল তারা দেখে। অঙ্কের ক্লাসে বিপদতারণ স্যর তাকে নিয়েই পড়েন। ব্ল্যাকবোর্ডে একটা শক্ত দেখে অঙ্ক লিখে মতিরামকে ডাকেন। মতিরামের হাতে চকপেন্সিল ধরিয়ে বলেন, বাবা মতিরাম, অঙ্কটা করে দেখাও তো। ক্লাসশুদ্ধু ছেলেরা মতিলালের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর সে এ দিকে চক হাতে এমন ভাবে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে যেন কথাগুলো অন্য কাউকে বলা হয়েছে। তার মাথার ভেতর সমস্ত ফর্মুলা একসঙ্গে প্রবল ভাবে ছোটাছুটি করতে থাকে। পাটীগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি সব জট পাকিয়ে যায়। মতিরামের সে জট ছাড়ানোর সাধ্যি নেই।
বিপদতারণবাবু মতিরামকে ঘামতে দেখে বলেন, বাবা মতি, অঙ্কটা দেখে কি বাঘ-ভালুক মনে হচ্ছে? নাকি ভূতটুত কিছু? অবশ্য অঙ্কে যার এত ভয় সে তো ভূতকে ভয় পাবেই। বা অন্য ভাবে বললে, যার অঙ্কে ভয় নেই তার ভূতকেও ভয় নেই। কী বলিস বাবা ভূতনাথ, না না, বাবা মতিরাম?
এর পর মতিরাম স্যরের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে নিজের জায়গাতে এসে বসে। মনে মনে ভাবতে থাকে এক বার জিজ্ঞেস করলে হয়, স্যর আপনি ভূতকে ভয় পান না?
বিপদতারণবাবু অঙ্কের জাহাজ। এই ‘জাহাজ’ নামটা ওঁকে কে দিয়েছে মতি জানে না। তবে এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ও জানে বিপদতারণবাবু অঙ্কের জাহাজ। স্কুলের আশেপাশে যে দশ-বিশটা গ্রাম থেকে ছাত্ররা পড়তে আসে সেই গ্রামের লোকজন সকলেই বিপদতারণবাবুকে মান্যিগন্যি করে। তাঁর গ্রাম স্কুল থেকে প্রায় পাঁচ মাইল দূরে। প্রতি দিন তিনি হেঁটে স্কুলে আসেন। মতিদের গ্রামের পাশ দিয়েই স্যর যাওয়া-আসা করেন। মাঝে একটা পলাশ জঙ্গল পড়ে।
মতি অঙ্কে যত কাঁচাই হোক, দুষ্টু বুদ্ধিতে মোটেই কাঁচা নয়। মাঝেমধ্যেই মজার মজার দুষ্টুমি তাঁর মাথায় উঁকি মারে। এক দিন মতি ভাবল, ওই পলাশ জঙ্গলে অঙ্কের স্যরকে ভূতের ভয় দেখালে কেমন হয়! স্যর তো বেশ বুক ফুলিয়ে সে দিন বলে দিলেন, যাঁরা অঙ্কে ভয় পায় না, তারা ভূতকেও ভয় পায় না। এক বার পরীক্ষা করেই দেখা যাক। |
মতি এক দিন স্কুল থেকে বাড়ি না গিয়ে সোজা পলাশ জঙ্গলে ঢুকে গেল। শীতের দিন। এরই মধ্যে আবছা আঁধার নেমে এসেছে। গাছের পাতা খসে খসে রাস্তা ঢেকে ফেলেছে। পথ দিয়ে হেঁটে গেলে মড় মড়, খস খস করে শব্দ হচ্ছে। পথ শুনশান। স্যরের ফিরতে আরও দশ-পনেরো মিনিট সময় আছে। হেডস্যর এখন ছুটিতে তাই বিপদতারণবাবুকেই সব দিকে নজর রাখতে হয়। নাইটগার্ড ডিউটিতে এসে গেলে তিনি আলমারি বন্ধ করে বাড়ির পথে রওনা দেন। যখন পলাশ জঙ্গলের রাস্তা পার হন, তখন অন্ধকার নেমে আসে।
বিপদতারণবাবু দেখতে পেলেন একটা লোক তার পিছনে আসছে। ওই লোকটার সঙ্গে গল্প করতে করতে জঙ্গলের রাস্তাটুকু পেরিয়ে যাবেন ভেবে তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। কিন্তু লোকটা গেল কোথায়? তিনি কয়েক পা এগিয়ে যেতেই আবার ছায়ামূর্তিটা দেখা দিল। অন্ধকারের মধ্যেও তিনি দেখলেন ছায়ামূর্তিটা বেশ লম্বা। এত লম্বা মানুষ হয়? বিপদতারণবাবু রোজই দু’বেলা এই পথেই যাওয়া-আসা করেন। বাড়ি ফিরতে প্রায় দিনই সন্ধ্যা হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে শেয়াল টেয়াল রাস্তায় এক বার দেখা দিয়েই দূরে ছুটে যায়। তবে ওই ছায়ামূর্তিটা কীসের? তিনি কি ভুল দেখলেন? চোরটোর নয়তো? অবশ্য চোর এলেও তার কাছে আর কী নেবে। হাতঘড়ি আর একটা কলম ছাড়া বেচারা কিছুই পাবে না। তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। আবার সেই একই ঘটনা। লম্বা মূর্তিটা লম্বা মতো দুটো হাত দোলাতে দোলাতে তার পিছু নিল। তিনি এ বার কিছুটা ভয় পেলেন। হাঁটার গতি বেশ বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু জোরে হাঁটতে গিয়েই বিপদটা হল। তিনি হোঁচট খেয়ে ধপাস করে পড়ে গেলেন। শুকনো পাতায় খস খস করে শব্দ হল। আর ঠিক তখনই পেছনের ছায়ামূর্তিটা তার পাশ দিয়ে দ্রুত ছুটে গেল। লম্বা হাত, লম্বা পা। মাথাটা বেশ লম্বা। মূর্তিটা দেখে তার ঠিক বোধগম্য হল না। তিনি রাস্তার মাঝে বসে রইলেন। হাঁটুতে অল্প চোটও লেগেছে। ভয়ে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।
মতি তার কালিঝুলি মাখা আলখাল্লাটা খুলে ফেলল। মাথার উপরে চাপানো লম্বা থলিটা, যেটা খড়-পাতা দিয়ে ভর্তি করা ছিল সেটাও ফেলে দিল। তার পর অন্য পাশ দিয়ে স্যরের কাছে এসে বলল, অন্ধকারে পথের মধ্যে কে? তার পর কাছে এসে চিনতে পারার ভঙ্গিতে বলল, ও স্যর আপনি? লাগেনি তো? মতি স্যরের হাত ধরে টেনে তুলল। বিপদতারণবাবু কোনও কথা না বলে সরু চোখে মতিকে নিরীক্ষণ করলেন। অন্ধকারে মতির মুখের রেখাগুলো ঠিক পড়তে পারলেন না। তিনি হন হন করে হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ঘরে ফিরে এসে জামাটা খুলতেই নজরে পড়ল কালির দাগ। ছোট ছোট পাঁচটা আঙুলের চিহ্ন। মতি যখন তাকে টেনে তুলেছিল সে সময়ই দাগটা জামাতে লেগেছে। এতক্ষণে তাঁর দুই দুইয়ে চার অঙ্কটা জলের মতো মিলে গেল।
গিন্নি চায়ের কাপটা হাতে দিতেই বিপদতারণবাবু মুচকি হেসে ফেললেন। গিন্নি শুধোলেন, হাসির কারণ? বিপদতারণবাবু বললেন, ভূত। না, না, শুধু ভূত নয়, অঙ্কের ভূত! আজ আমার পিছু নিয়েছিল কিনা। স্যরের বউ বললেন, অঙ্কের ভূত তো তোমার মাথায়। পিছু নিতে যাবে কেন? ওই ভূতটাই তো ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে রাতদিন ভয় দেখাচ্ছে। আচ্ছা অঙ্কগুলোকে সহজ করে বোঝানো যায় না? বিপদতারণবাবু বললেন, এ বার তাই চেষ্টা করে দেখব। যাতে অঙ্কের নাম শুনে কেউ ভয় না পায়। |