প্রবন্ধ...
সেই সব ‘রবি’বার
বিশঙ্কর দৈহিক উচ্চতায় ছিলেন নেপোলিয়নের মতো, অর্থাৎ ছোট্টখাট্টো। এবং, ওই ফরাসি সম্রাটের মতোই, ওঁর থেকে নজর সরানো প্রায় অসম্ভব ছিল। প্রায় দেবতার মতো এক মুখশ্রী, সে-মুখে বালকের কৌতূহল ও বিস্ময়-ভরা দুই আয়তনেত্র, একমাথা কোঁকড়া চুল আর মুক্তোর দাঁতে ভুবনমোহিনী হাসি ওঁর সামনে বসে স্মৃতিকথা রেকর্ড করার সময় অবিচল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই হত ওই মুখের দিকে।
যতই চোখ ভরে দেখি না কেন, ওঁর বলা কথা থেকে মন সরাবার জো ছিল না। কারণ, স্মৃতি হাতড়ে, মাথা খাটিয়ে, প্রায় তদ্গত হয়ে কথা বললেও ওঁর পুরো খেয়াল থাকত আমার শোনা ও প্রতিক্রিয়ার ওপর। লন্ডনে ওঁর হোটেল অ্যাপার্টমেন্টে কখনও দেরি করে গেলেও উনি রাগ করেননি, কিন্তু ওঁর কথার মধ্যে ক্বচিৎ কখনও এতটুকু আনমনা হলেই উনি আহত হতেন। রস করে বলতেন, ‘খোকার বোধহয় ঘুম পেয়েছে। এসো, চা খাওয়া যাক।’
চায়ের শেষে কী ভাবে যে ছেড়ে আসা কথাকে ঠিক সেই অমোঘ মুহূর্ত থেকে ধরতেন, তাতেই তাজ্জব হয়ে যেতাম। কী স্মৃতিধর মানুষ রে বাবা! গোটা বইটাই কিন্তু উনি গড়গড় করে মন থেকে আউড়ে গেছেন, কখনও কোনও তত্ত্ব বা তথ্যের জন্য বইয়ের পাতা না উল্টে। তা ছাড়া, বই তো লেখা হয়েছে চলতে চলতে, হিল্লিদিল্লি করে, কখনও দিল্লি, কখনও মাদ্রাজ, কখনও কাশী, কখনও লন্ডনে। সেখানে বই কোথায়? আর যাত্রাকালে হাতে থাকত টাইম, নিউজউইক পত্রিকা, বই হলে লেটেস্ট থ্রিলার বা বেস্টসেলার। ‘লুডলাম কেমন লাগে?’ এক দিন জিজ্ঞেস করেছিলেন আমাকে। এক দিন আমেরিকা থেকে ফোন করে বললেন, ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ আছে? ওঁকে বোলো ‘সেই সময়’ পড়ে কী আহ্লাদ হল। সামনে পেলে গালে চুমু দিয়ে দোব।’ পরে কলকাতায় এসে বলেছিলেন সুনীলদাকে, তাতে রীতিমত চমকিত সুনীল আমাকে বললেন, ‘রবিশঙ্কর এত পড়াশুনোর সময় পান কখন? গতকাল ফোনে আমায় কী বললেন জানো? বললেন, আপনার গালে চুমো দিতে ইচ্ছে হল বইটা শেষ করে।’ আর এক বার সেই বিদেশ থেকেই ফোনে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জয় গোস্বামীকে চেনো?’ বললাম, বিলক্ষণ। তখন বললেন, ‘এক বার আমার কাছে নিয়ে এসো ছেলেটাকে। অসাধারণ কবিতা লেখে।’ টাউন হলে রবিশঙ্করের এক সংবর্ধনায় নিয়েও গিয়েছিলাম জয়কে। কবিতা পড়ল।
মাল্টিটাস্কিং বলে যে কথাটা এখন খুব বাজারে চলছে, তার এক নিপুণ নমুনা দেখেছিলাম রবিশঙ্করের মধ্যে; তবে বিশেষত্ব একটাই দশটা কাজের যেটাই করছেন, সেই সময়ে তাতেই ডুবে আছেন। যখন ‘রাগ-অনুরাগ’-এর কাজে ন্যস্ত, তখন মনে হচ্ছে এর বাইরে ভদ্রলোকের কিছুই করার নেই।
তার পর যেই সে-কাজ চুকল, অমনি সিতার কনচের্তোর নোটেশন করতে বসে গেলেন। সন্ধে নামতেই তড়িঘড়ি সাজগোজ করে কমলা চক্রবর্তীকে নিয়ে রওনা দিলেন রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে রুবিনস্টাইন-এর পিয়ানো কনসার্ট শুনতে। যাবার আগে আমাকে একটা ছোট্ট নির্দেশ, ‘আজকের কথাগুলো রাতে লিখে ফেলতে পারবে তো? তা হলে কাল সন্ধেয় বার্গম্যানের ছবিটা একসঙ্গে বসে দেখা যাবে ওভার ডিনার।’
বার্গম্যানের ছবি বলতে বিবিসি চ্যানেলের ছয় এপিসোডে তোলা টেলিসিরিয়াল ‘সিক্স সিনজ ফ্রম আ ম্যারেজ’। প্রতি শনিবার ওই ছবি দেখার পর কমলাদি চোখের জল মুছতে মুছতে পাশের ঘরে চলে যেতেন, আর রবিশঙ্কর উদাস চোখে জানালার বাইরে অন্ধকারের দিকে চেয়ে বসে থাকতেন। এক সময় একটা অজুহাত খাড়া করে আমি নিঃশব্দে বেরিয়ে আসতাম। ছয় এপিসোডের কোনওটারই শেষে আমার ডিনার খাওয়া হয়নি ওঁদের সঙ্গে। কিন্তু আমার পাওনাটা ছিল অন্যত্র। আমি এক নির্জন, প্রায় নিঃসঙ্গ, বেদনাহত রবিশঙ্করের হদিশ পাচ্ছিলাম, ভুবনজোড়া খ্যাতি ও গ্ল্যামারের আড়ালে হারিয়ে থাকা এক অপূর্ব মানুষ।
প্রথম দিকে অন্নপূর্ণা দেবীকে নিয়ে প্রশ্ন করলেই উনি এড়িয়ে যেতেন। এক দিন বললেন, ‘অত ব্যক্তিগত হওয়ার কি দরকার আছে?’ আমি বললাম, ‘আপনার স্মৃতিকথায় অন্নপূর্ণা থাকবেন না...’ কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘বুঝেছি, বুঝেছি...হবে, হবে।’ এর পর আস্তে আস্তে জমিটা তৈরি করল বার্গম্যানের ছবিটাই। হঠাৎ এক দিন চেলসির অভিজাত রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে থমকে পড়লেন শিল্পী, বললেন ‘তুমি অন্নপূর্ণাকে নিয়ে কী সব জিজ্ঞেস করতে না? কাল রাতে এই সবই ভাবছিলাম...’ তার পর হোটেলে ফিরে যখন বলতে শুরু করলেন, গলার আওয়াজ মাঝে মাঝে ভেঙে যাচ্ছিল। খুব ভুল হবে না যদি বলি যে সেই প্রথম এই সদানন্দ মানুষটির চোখের কোণে ক্ষণিকের জন্য হলেও জল চিকচিক করে উঠতে দেখেছিলাম।
দ্বিতীয় বার রবিশঙ্করের চোখে জল চিকচিক করতে দেখেছিলাম কলকাতার কেনিলওয়র্থ হোটেলে এক দুপুরে। আনন্দবাজার পত্রিকার পূজাবার্ষিকীর জন্য একটা সাক্ষাৎকার নেবার সময়। কারণ, সে দিনের সেই স্মৃতি রোমন্থনের কেন্দ্রে এসে পড়ছিলেন ওঁর মা হেমাঙ্গিনী দেবী। কাশীর বাঙালিটোলার ভাড়াবাড়িতে কাটানো কষ্টের দিনগুলো সারাটা জীবন তাড়া করে ফিরেছে রবিশঙ্করকে। বাবা শ্যামশঙ্কর চৌধুরী সমেত স্ত্রীকে কাশীতে ফেলে তখন বিদেশে। তাঁর হদিশই নেই কারও। তাঁর ২০০ টাকার পেনশন বারো হাত ঘুরে মায়ের হাতে আসতে আসতে ৬০ টাকায় দাঁড়াত। এক পুত্র প্লেগে মারা যাওয়ায় ভাইদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল চারে। জ্যেষ্ঠ উদয়শঙ্কর তখন লন্ডনে, পেন্টিং শিখতে। মেজ ও সেজ ছেলে কলেজ ও ইস্কুলে যায়, ছোটজন রবু থাকে মা-র আঁচল ধরে। সে দেখে মা-র সংসার চালানোর রাস্তা দাঁড়িয়েছে টাকার টান পড়লেই পাড়ার দুঃখী তেলীর দোকানে গিয়ে জিনিস বাঁধা দেওয়া। হয় একটা শাড়ি, নয় নাকের ফুল কি কানের দুল, এই সব। রবিশঙ্কর লিখছেন, ‘এই করে উনি আমাদের মানুষ করেছেন কাউকে জানতে দেননি। আমার দাদারাও জানতে পারত না। আমিই দেখতাম।’...সেই থেকে আমার মধ্যে একটা anti-father feeling এসে গিয়েছিল। উনি তো দূরে দূরে থাকতেন, এক মেম বিয়ে করেছিলেন...’
মা’কে শেষ বারের মতো দেখেছিলেন বম্বের জাহাজ ডকে। দাদা উদয়শঙ্করের নাচের দলের একক বাদক হিসেবে যোগ দিয়েছেন আলাউদ্দিন খাঁ, বম্বে থেকে জাহাজে করে দল বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। দলের সঙ্গে যাচ্ছে বালক রবি। রবিশঙ্কর লিখছেন, ‘মা-র হঠাৎ কী যে হল premonition, perhaps she knew আমার হাতটা বাবার হাতে দিয়ে বললেন, বাবা আপনাকে একটা কথা বলব? ‘বলেন মা বলেন’, বাবা তো একেবারে অস্থির হয়ে গেলেন ‘আদেশ করেন’। ‘না, আপনি তো জানেন এর বাবা মারা গেছেন, বড় দুরন্ত ছেলে এখন তো কেউ নেই। আপনি একটু দেখবেন। ভুলটুল হলে মাপ করে দেবেন।’ এর পরই শুরু হল বাবা আলাউদ্দিন আর মা হেমাঙ্গিনীর গলা ছেড়ে হাউহাউ করে কান্না। যখন জাহাজ ছেড়ে দিল, রবি সমানে দেখে গেল ডকে দাঁড়িয়ে মা, পরনে ঢাকাই শাড়ি, হাত নেড়েই চলেছেন। কিছু দিন পর খবর এল উনি চলে গেছেন। রবির বাল্যকাল শেষ হয়ে গেল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.