ভারতীয় ইনিংসের একটা উইকেট পতনে ব্রিটিশ সাংবাদিকদেরও ঘোর বিষণ্ণ দেখাল! সচিন তেন্ডুলকরের নয়! শুক্রবার লাঞ্চের পর যুবরাজ সিংহের!
ব্রিটিশ প্রেসের শীর্ষস্থানীয় জনাকয়েক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে মনে হল আধুনিক ক্রিকেটের সবচেয়ে রোম্যান্টিক কাহিনি মোতেরার দ্বিতীয় দিনে ঘটবে বলে তাঁরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। আর ৭৪ রানে যুবরাজের ফুলটসে উইকেট দেওয়াতে সেই কাহিনির চিতাভস্ম প্রবল বেদনার সঙ্গে কুড়োলেন। মাত্র ২৬ রানের জন্য তৈরি হল না ক্রিকেট রূপকথার নতুন ব্যাঙ্ক। ক্যানসার সারিয়ে উঠে প্রথম টেস্ট ম্যাচেই সেঞ্চুরি!
টিম যুবরাজের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, তারা কিন্তু যথেষ্টই সন্তুষ্ট। মনে করে এর পর ইংল্যান্ডের বাকি দুই ইনিংসে যদি যুবরাজ কয়েকটা উইকেট নিয়ে নিতে পারেন, টেস্ট ক্রিকেটে ধুমধামের সঙ্গেই তাঁর প্রত্যাবর্তন সূচিত হবে! ভারত খোঁজ পাবে সেই অলরাউন্ডারের। যাঁকে টেস্ট টিম গত কয়েক বছর ধরে ব্যাকুল ভাবে খুঁজে চলেছে। এক সময়ের মেন্টর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়েরও মনে হচ্ছে, “যুবি এখন টেস্ট-ফিট।”
যুবরাজ কাল ব্যাট করতে নামার সময় সবাই দাঁড়িয়ে উঠে আবেগঘন সম্মান জানিয়েছিল। আজ আউট হয়ে ফেরার সময়ও মোতেরা স্বতঃস্ফূর্ত উঠে দাঁড়াল। ভারতীয় ক্রিকেটের আর সব কামব্যাক কাহিনিকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন যুবরাজ। ক্যানসারের পর টেস্ট ক্রিকেটে এমন শোভিত প্রত্যাবর্তন কেউ কখনও দেখেনি। এ দিন যখন পূজারার সঙ্গে পার্টনারশিপে এককে দুই, দুইকে তিন রান করার জন্য প্রাণপণ দৌড়াচ্ছেন, তখনও কারও কারও ভয় লাগছে, এই না বুঝি লুটিয়ে পড়েন যুবরাজ। আর তখন তাঁর অধিনায়কের আশঙ্কাটাই সত্যি হয়ে যাবে! |
এমনিতে টিম যুবরাজ ম্যাচের আগের দিন সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর সম্পর্কে ধোনির তির্যক মন্তব্য আড়াল করে রেখেছে। যুবরাজের কাছে আড়াল করায় তাদের আরও সুবিধে হয়েছে গুজরাতি নববর্ষের জন্য স্থানীয় কাগজ দু’দিন বন্ধ থাকায়। যুবির হাতে কোনও লেখালেখিও পৌঁছায়নি। টিম যুবরাজ মনে করে নেগেটিভ কোনও রকম চিন্তা এই টেস্ট ম্যাচের আবহে যুবরাজের কাছে যেতে দেওয়া ঠিক হবে না। প্রত্যাবর্তন ম্যাচটা তাঁর কাছে অসীম গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসাকালীনও বারবার বলেছেন, মারা যদি যাই সেটা যেন টেস্ট ম্যাচ খেলতে গিয়ে ঘটে!
সেঞ্চুরি না হোক, যুবরাজের এ দিন বড় রান পাওয়াটা অবশ্যই তাঁকে ঘিরে তৈরি সিরিয়াল নির্মাতাদের খুশি করবে। শনিবার থেকে কালার্স টিভিতে তো শুরু হচ্ছে তাঁকে নিয়ে সিরিয়াল ‘জিন্দগি অভি বাকি হ্যায়’। যেখানে ইন্ডিয়ানাপোলিসে তাঁর অসুস্থতা। কেমোথেরাপির পর মানসিক ও শারীরিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়া। চুল পুরো উঠে যাওয়া। বমি করতে থাকা। সব কিছু নাকি সবিস্তারে দেখানো হয়েছে।
মধ্য নভেম্বরের এই যুবরাজ লিফট করে সোয়ানকে স্ট্রেট ছক্কা মারছেন। টিনএজারের উৎসাহে দৌড়ে সিঙ্গলস নিচ্ছেন। মধ্য ফেব্রুয়ারির যুবরাজ দূর দেশে নিজেকে মৃত্যুপথযাত্রী ধরে নিয়ে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়তেন। এক বন্ধু বলছিলেন, “বেচারি যা খেত তাই বমি হয়ে যেত। এক দিন এমন হল বমি হচ্ছে না, হচ্ছে না। যুবি আশ্বস্ত হচ্ছে, যাক আজকের খাবারটা হজম হল। সেটাও দেখা গেল ন’ঘণ্টা বাদে বমি হয়ে গেছে।” এই সময় হরভজন সিংহের কাজ ছিল দেশ থেকে ফোন করে করে বন্ধুকে নানান জোকস শোনানো। ফোনটা ছেড়ে দিয়ে ভাজ্জি বেশির ভাগ দিনই কাঁদতেন। কিন্তু ফোনের সময়টুকু তাঁকে অভিনয় করতেই হত। পরে হরভজন বললেন, “ভাগ্যিস আমাকে মুখোমুখি দাঁড়াতে হত না। তা হলে আর হাসাতে পারতাম কি না জানি না।”
বিরাট কোহলি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। রাহুল দ্রাবিড় খোঁজ নিতেন। আর এক জন সটান ইন্ডিয়ানাপোলিসে এসে দেখা করে যান। তিনি অনিল কুম্বলে। কুম্বলের কাছে টিম যুবরাজের কৃতজ্ঞতার অবধি নেই। আর প্রথম দিন থেকে অভিভাবকের মতো যিনি সযত্ন মানসিক আশ্রয়ে রেখেছেন, তিনি সচিন তেন্ডুলকর! ভারতীয় টেস্ট নেটে যুবরাজকে নিয়ে গত ক’দিন প্রচুর রগড়েছেন সচিন। শিষ্যের ৭৪ রান সচিনকে নিজের প্রথম ইনিংসের ব্যর্থতাকে অনেকটা সহনীয় করে দেবে সন্দেহ নেই।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুবরাজ লন্ডনে নামার পর শুধু তাঁর সঙ্গেই দেখা করতে লন্ডন উড়ে যান সচিন। যাওয়ার আগে তাঁর ভয় ছিল একটাই। “কী করে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াব? আমার তো ওকে দেখামাত্র কান্না পাবে। সামলাব কী করে?” কালার্স টিভিতেও নাকি সচিন বলেছেন যে, নিজের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করেছেন। কী ভাবে না-কেঁদে তিনি নিজেকে সামলাবেন?
অথচ সমস্যা হয়নি। প্রথম মিনিট থেকে যুবরাজ এমন হাসি-ইয়ার্কি জুড়ে দেন যে, সচিনও হাসতে শুরু করেন।
এ দিন মোতেরা প্রেসবক্সে ব্রিটিশ সাংবাদিকেরা আলোচনা করছিলেন এমন অসম সাহসী যুবরাজের ছবি ভারতের সব ক্যানসার বিশেষজ্ঞের চেম্বারের ওয়েটিং রুমে লাগিয়ে রাখা উচিত। মনে হয় না অন্তত এই একটা প্রস্তাবে একমত হতে ভারতীয় মিডিয়ারও কোনও সমস্যা থাকবে। যতই ডিআরএস নিয়ে তাঁরা এক বছর যাবৎ দুটো ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা হন! |