|
|
|
|
পূজারার নৈবেদ্য |
দু’শোয় উজ্জ্বল পূজারা, একা লড়েও তোপের মুখে সোয়ান |
গৌতম ভট্টাচার্য • আমদাবাদ |
এই পরিস্থিতিতে খুব পরিচিত যে প্রশ্নটা উঠে পড়ে এবং যার জবাব দিতে শুরু করে দেন বিশেষজ্ঞরা, সেটা ঘটে গিয়েছে! ক’দিনে এই টেস্ট জিতবে ভারত?
নভজোৎ সিংহ সিধু: সোয়া চার দিনে। বড় জোর ফিফথ ডে লাঞ্চ।
অরুণ লাল: পৌনে চার দিনে শেষ।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়: ইংল্যান্ড এই ভাবে ব্যাট করলে চার দিনও যাবে না।
সম্পূর্ণ একপেশে হয়ে পড়া টেস্টে চেতেশ্বর পূজারার অপরাজিত ডাবল সেঞ্চুরিতে ইংল্যান্ড যদি সম্পূর্ণ পিষ্ট হয়ে থাকে, তাদের জন্য সামান্য সম্ভ্রম আনলেন একমাত্র গ্রেম সোয়ান। সোয়ান ইংল্যান্ডের এই দলের এক জন কর্মকর্তা গোছের। পিটারসেন-বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ভাবমূর্তির তুলনা করতে গেলে যেন ইংল্যান্ডের সহবাগ! আজকের পর সোয়ান এমন পাদানিতে, যেখান থেকে ভারত-ইংল্যান্ড আশি বছরের টেস্ট ইতিহাসে নিজের দলে সর্বকালের সেরা অফস্পিনারের মনোনয়ন পেতে পারেন তিনি! এ দিনের ৫-১৪৪ এর পর ৪৭ টেস্টে সোয়ানের উইকেট সংখ্যা ১৯৭। সমসংখ্যক টেস্টে ডেরেক আন্ডারউডের ১৭২। কত পিছনে! গোটা দলের হতমান অবস্থায় একমাত্র সোয়ানকে ঘিরে ইংল্যান্ডের ভরসার তরঙ্গ থাকবেই। বিশেষ করে বাকি তিন টেস্টের জন্য। |
|
কাহিনির ‘ইন্টারেস্টিং’ মোড় এখানেই! ইংল্যান্ড যাঁকে সফল বোলার এবং ম্যাচে তাদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখ হিসেবে দেখছে, উপমহাদেশ তাঁকেই কি না একযোগে ধিক্কার জানাচ্ছে। শুক্রবার যেমন রামিজ রাজা বলছিলেন, “এই উইকেট পেয়ে এটা কী করল সোয়ান? ওর তো উচিত ছিল কনুই ভেঙে ছোড়া। ১৫ ডিগ্রি অবধি তো ছাড় আছে। সেটা করলে তো আজ ওর ৫-৪৪ হয়। পূজারার রানটা হয় না।” রামিজের পাশে তখন সিধু। তিনিও একমত, “তুমি তো বাবা অবৈধ কিছু করছ না। আইসিসি যেটুকু ছুড়তে অ্যালাও করেছে, তুমি তাই ছুড়ছ।” অরুণলাল বললেন, “সইদ আজমল তো ১৫ ডিগ্রি আইন মেনেই ছোড়ে। আর বিপক্ষকে ধসিয়ে দেয়। তা হলে সোয়ানের আপত্তি কেন?”
কিন্তু অফস্পিনার হিসেবে কেউ যদি সাবেকি, ক্ল্যাসিক্যাল থাকতে চায়, সে অনর্থক ছোড়াছুড়ির মধ্যে যাবে কেন? রামিজ বললেন, “যাবে। যাবে টিমের প্রয়োজনে। আইনই যদি থাকে, মিনিমাম চাক করতে পারো। তার সুবিধে না নেওয়াটা তো বোকামি। ভারতকে আজ কোথায় ধসিয়ে দেওয়া যেত। তা নয়, সোয়ান নিজের ইমেজ নিয়ে রইল। যা তা।” সিধু তখন ঘাড় নাড়ছেন।
রামিজ মনে করেন, ইমরান ক্যাপ্টেন হলে সোয়ানের ওপর আজ প্রচণ্ড চটে যেতেন এবং ক্ল্যাসিকাল বোলিংকে দল-বিরোধী কাজ হিসেবে ধরতেন। তাদের পাকিস্তান টিম রিভার্স সুইংয়ের জন্য বিশ্ববিখ্যাত ছিল। এত ভাল বলের ব্যবহার তখন বিশ্বে অন্য কোনও টিমের ছিল না। রামিজ-সহ সব ব্যাটসম্যানকে ডেকে ইমরান বলেছিলেন, “বোলার না হলেও তোমাদের বুঝতে হবে, এই বল হল আমাদের গোটা সংসারের মেহবুবা। মেহবুবাকে নিরন্তর মাথায় করে রাখতে হবে। দেখতে হবে এক দিকটায় যাতে পালিশ থাকে। আর এক দিকটা ছিবড়ে হয়ে যায়। তা হলেই বল রিভার্স করবে।” |
|
মোতেরার গ্যালারিতে পূজারার হবু স্ত্রী পূজা। শুক্রবার। |
সফরকারি ইংল্যান্ড এত নির্মম পেশাদারিত্ব দেখানোর জায়গায় নেই, বোঝাই যাচ্ছে। স্ট্র্যাটেজির বিভ্রাটেও তারা মরমে মরে রয়েছে। এ দিন তাদের পেস বোলার প্রথম উইকেট পায় ১৫৮তম ওভারে। অথচ তারা মন্টি পানেসরকে বসিয়ে তিন পেসার খেলাচ্ছে। ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ গবেষণা জানাচ্ছে, ১৯৯৩-এ ইডেন টেস্টের পর গত উনিশ বছরে তাদের কৌশলে এত বড় ভুল হয়নি। সে বার ইডেনের স্পিনিং ট্র্যাকে তারা চার পেসার খেলায় এবং হারে।
এ দিন অশ্বিন-ওঝার সামনে ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যানদের কম্পিত ফুটওয়ার্ক দেখে মনে হল, বিলেতে গত গ্রীষ্মের দ্বৈরথটাই অবিকল ফেরত এসেছে। শুধু ওখানে যারা শাসক ছিল, এখানে শোষিত। আর ওখানে যারা শোষিত শ্রেণি ছিল, তারা আজ অত্যাচারী মালিকপক্ষ। রবিচন্দ্রন অশ্বিন ভারতীয় বোলারদের মধ্যে দ্রুততম হিসেবে টেস্টে ৫০ উইকেট পেলেন। মাত্র ৯ টেস্টে তাঁর কীর্তি। কুম্বলে যা করতে নিয়েছিলেন ১০ টেস্ট। হরভজন-চন্দ্রশেখররা নিয়েছিলেন ১১ টেস্ট।
ডেনিস কম্পটনের নাতি নিককে ব্যাট-প্যাডের মাঝখান দিয়ে যখন বোল্ড করলেন অশ্বিন, দাদুর স্পিন খেলার রেকর্ডটা বার করে আনলেন কেউ। ভারতে ১০ ম্যাচে ১৩০৬ রান। গড় ৮৭। হায়, এই ইংরেজদের তো কোনও ডেনিস কম্পটন নেই। তাদের শেষ ভরসা সেই কেভিন পিটারসেন।
ডিন জোন্স টুইটে ভাল অস্ট্রেলীয় খোঁচা দিয়েছেন। মাত্র ক’দিন আগেই পিটারসেন ছিল ইংল্যান্ড শিবিরের সমস্যা। শুক্রবার খেলার পর সেই পিটারসেনই নাকি সমস্যা তাড়ানোর সম্ভাব্য নায়ক। |
ঘরোয়া ক্রিকেটে |
২০০৮: ২২ দিনে তিনটে ট্রিপল সেঞ্চুরি। দু’টো সি কে নায়ডুতে, একটি রঞ্জিতে।
২০০৮-০৯: রবীন্দ্র জাডেজার সঙ্গে রঞ্জিতে ৫ম উইকেটে ৫২০। ও-ভাইদের প্রথম শ্রেণির ম্যাচের রেকর্ড ভাঙেন। |
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে |
• প্রথম ৯ টেস্ট ইনিংসে মোট রানে ভারতীয়দের মধ্যে কাম্বলী (৭৯৮), গাওস্করের (৭৭৮) পরেই।
• ছ’নম্বর টেস্টেই ডাবল সেঞ্চুরি। এ ক্ষেত্রেও আগে শুধু কাম্বলী (তৃতীয় টেস্টে) ও গাওস্কর (চতুর্থ টেস্টে)।
• পূজারার এখন টেস্ট গড় ৬০.৭৫। যা সচিনের সেরা গড় (৫৯.১৭)-এর থেকেও বেশি। |
|
ইংল্যান্ডের এই ঐতিহাসিক দ্বিচারিতা চেতেশ্বর পূজারার সমস্যা নয়। তাঁর জীবনের একমাত্র প্রার্থনা। বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ হল রান। আরও বড় রান। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১৬টা সেঞ্চুরি করেছেন পূজারা। এর মধ্যে ন’টা ইনিংস টেনে নিয়ে গেছেন দেড়শোর ওপারে। হাঁটুতে দু’টো অস্ত্রোপচার হয়েছে। আইপিএলে ফিল্ড করার সময় পাওয়া চোটে। যার একটায় গায়ে জার্সি ছিল কলকাতা নাইট রাইডার্সের। এ দিন তাঁর ব্যাটিং দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, টেস্ট ক্রিকেট বুঝি ১৯৭০ সালে ফেরত গেছে। আধুনিক ক্রিকেটার, অথচ অপরাজিত ২০৬ রানের মধ্যে এক বারও বল তুললেন না। মাঠে মুহুর্মুহু কমেন্ট্রি বক্সে বসে থাকা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে তাঁর তুলনা করা হল। যাঁর নাম রাহুল দ্রাবিড়। কিন্তু স্ট্রোক খেলার ভঙ্গী, অলস হাঁটাচলা, ডাবল সেঞ্চুরির পর অভিনন্দন নেওয়া, এগুলোতে তিনি মোটেও দ্রাবিড় নন। বরঞ্চ ভিভিএস লক্ষ্মণ। যুবরাজ আর তাঁর ষষ্ঠ উইকেট পার্টনারশিপ ইংল্যান্ডকে ম্যাচ থেকে আরওই বার করে দিল। যুবরাজ সেঞ্চুরি না পান, ব্যাট হাতে ঝকঝক করলেন। বিদেশে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর গড় মাত্র ১৯। যা প্রথম সুযোগেই শুধরে নিতে চান। দেশের মাঠে সোয়ানের সামনের পরীক্ষায় তাঁকে অকুতোভয় দেখাচ্ছিল। ক্যানসার পরবর্তী তাঁর বোধহয় মনোভাবটাই এ রকম। সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কী ভয়!
ইনিংসে হার এড়াতে ইংল্যান্ডকে আরও ২৮০ রান করতে হবে। প্রথম টেস্ট যদি তারা বাঁচিয়ে ফেলে, তা হলে গাঁধীজির লবণ সত্যাগ্রহ ফিরে আসার মতো রোমহর্ষক কিছু না ফের ঘটে যায় আমদাবাদে! |
ভারত প্রথম ইনিংস (আগের দিন ৩২৩-৪) |
পূজারা নঃআঃ ২০৬
যুবরাজ ক সোয়ান বো সমিত ৭৪
ধোনি বো সোয়ান ৫
অশ্বিন ক প্রায়র বো পিটারসেন ২৩
জাহির ক ট্রট বো অ্যান্ডারসন ৭
প্রজ্ঞান নঃআঃ ০
অতিরিক্ত ১২
মোট ৫২১-৮ (ডিঃ)
পতন: ১৩৪, ২২৪, ২৫০, ২৮৩, ৪১৩, ৪৪৪, ৫১০, ৫১৯
বোলিং: অ্যান্ডারসন ২৭-৭-৭৫-১, ব্রড ২৪-১-৯৭-০, ব্রেসনান ১৯-২-৭৩-০,
সোয়ান ৫১-৮-১৪৪-৫, সমিত ৩১-৩-৯৬-১, পিটারসেন ৮-১-২৫-১।
|
ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংস |
কুক ব্যাটিং ২২
কম্পটন বো অশ্বিন ৯
অ্যান্ডারসন ক গম্ভীর বো প্রজ্ঞান ২
ট্রট ক পূজারা বো অশ্বিন ০
পিটারসেন ব্যাটিং ৬
অতিরিক্ত ২
মোট ৪১-৩
পতন: ২৬, ২৯, ৩০
বোলিং: অশ্বিন ৮-১-২১-২, জাহির ৫-৩-৬-০,
প্রজ্ঞান ৪-১-৩-১, যুবরাজ ১-০-৯-০। |
|
|
ছবি: উৎপল সরকার |
|
|
|
|
|