জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া রাখালদেবীতে স্কুল মাঠে মঞ্চ বাঁধা হয়েছে। শুক্রবার বিকেল থেকেই মাঠে হাজির গ্রামবাসীরা। অপেক্ষা চলছে শিল্পীদের। স্থানীয় একটি ক্লাবের উদ্যোগে মঞ্চস্থ হবে নাটক, ‘একদিন-প্রতিদিন’।. কুশীলবরা আসার আগে থেকেই মঞ্চ আগলে পুলিশ। অভিনেতারা সকলেই কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। গাড়ি থেকে তাঁরা মাঠে নামতেই চারদিক থেকে তুমুল হাততালি। যেন বরণ করা হল তাঁদের। যা দেখে অভিভূত নব নন্দী, রতন দেবনাথ, গোপাল বর্মনরা। ওঁদের সকলেরই দিনরাত কাটে জেলে। সেই দেওয়ালের বাইরে তাদের জন্য এত হাততালি দেখে অভিনেতাদের অনেকেই চোখ মুছলেন। জলপাইগুড়ি কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের নাটকের দল ‘মুক্তি পিয়াসী’। জেল কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এই নাটকের দলের জেলের বাইরে শুক্রবার ‘রাখাল দেবী মঞ্চ’-এ হল প্রথম প্রকাশ্য অনুষ্ঠান। এর আগে অবশ্য প্রশাসনিক আধিকারিকদের উপস্থিতে জেলে একাধিক বার নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। নাটকের বিষয়ও জেলের জীবন। নাটক লিখেছেন কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের জেলার অনিরূদ্ধ গুপ্ত। নির্দেশনা ওঁরই। মঞ্চসজ্জা থেকে কুশীলবদের সাজসজ্জার তদারকি করেছেন কারারক্ষীরাই। জেলার অনিরুদ্ধবাবুর কথায়, “জেল মানেই অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা পরিবেশ। এই ধারনার কোনও ভিত্তি নেই। তা বোঝাতেই এই নাটক। বন্দিদের সকলেরই নিজস্ব একটা সত্ত্বা রয়েছে। যে সত্ত্বা কখনও অপরাধের গ্লানি থেকে মুক্তি খোঁজে। কখনও বা প্রিয়জনদের কথা ভেবে ছবি আঁকে। |
জলপাইগুড়িতে বন্দিদের নাটক। ছবি তুলেছেন সন্দীপ পাল। |
এমনই নানান টুকরো টুকরো দৃশ্য নিয়ে তৈরি হয়েছে নাটকটি। এই নাটকের অভিনেতারা প্রত্যেকেই নিজেদের নামের চরিত্রের অভিনয় করেছেন। কোনও এক অভিযোগে অভিযুক্ত এক সাংবাদিক-লেখককে একদিনের জন্য জেলে বন্দি থাকতে হয়। সেই সাংবাদিকের চোখে জেলের অনান্য বন্দিদের কাহিনি নিয়ে তৈরি হয়েছে একদিন প্রতিদিন নাটকটি। জেলার অনিরুদ্ধবাবু জানালেন, নাটকে যে বন্দিদের জীবনের গল্প বলা হয়েছে, তা কিন্তু পুরোপুরি বানানো নয়। কিছু কিছু সত্যি ঘটনা। যেমন, একটি শিশুকে খুনের অভিযোগে, সাজাপ্রাপ্ত বন্দি রতন দেবনাথের কথা ধরা যাক। গভীর রাতে জেলের কুঠরিতে বসে সাংবাদিকের সামনে আর্তনাদ করে ওঠেন তিনি। বলতে থাকেন, “আমি ভাবতেই পারিনি আমার জীবনের ১৬ বছর জেলে কেটে যাবে। কিন্তু যে শিশুটি আমার হাতে প্রাণ হারাল ওর মুখটা কেন আমি ভুলতে পারি না। আমার না হয় ১৬ বছর কেটে যাবে। কিন্তু ওর মুখটা কখনও কি আমার জীবন থেকে মুছবে না?” অথবা যে যুবকটি জেলে ভেতরেই প্রতিদিন ছবি আঁকে। আর ছবির দিকে তাকিয়ে প্রেমিকার কথা ভাবে। ব্যকড্রপে গুনগুনিয়ে ওঠে, “দাড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে.....। নাটক এবং জীবন এসে যেন একই মঞ্চে মিশে যায়। জেলার অনিরূদ্ধবাবুর দাবি, “এই নাটকটি দেখলে জেলের বন্দিদের প্রতিদিনের জীবন সম্পর্কে একটা ধারনা করা যাবে। ওরাও যে আমাদেরই মত তা স্পষ্ট হবে। ইচ্ছে এই নাটকটি নিয়ে বিভিন্ন শহরে মঞ্চস্থ করা। আমরা চাইছি বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদ্যোক্তা এগিয়ে আসুক। তারা আগ্রহ প্রকাশ করলেই আমরা নাটক নিয়ে তাদের অনুষ্ঠানে যেতে পারি।” জেল সূত্রেই জানা গেল আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার উদ্যোগে দেশ ব্যাপী আয়োজিত নাটক প্রতিযোগিতায় জলপাইগুড়ি কেন্দ্রীয় সংশোধোনাগারের এই দলটি অংশগ্রহণের অনুমতি পেয়েছে। প্রায় দেড় ঘণ্টার নাটকে দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীতও রয়েছে। গেয়েছেন জেলার নিজেই। |