জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি নয়, রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হতে চলেছে সেই মে মাসেই।
আগামী বছরের গোড়ায় পঞ্চায়েত ভোট করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের কাছে আপত্তি জানিয়েছিল বিরোধী দলগুলি। সেই দাবি মেনে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন ভোট এগিয়ে আনার কথা ভাবা হচ্ছিল, তার ব্যাখ্যা দিয়ে মমতা বলেন, “জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে আবহাওয়া ভাল থাকে। মে-জুনের গরমে ভোট হলে সব দলের নেতা-কর্মীদেরই কষ্ট হয়। কষ্ট হয় ভোটারদেরও। কিন্তু বিরোধী দলগুলি যদি আরও সময় চায়, তাতে আমাদের কোনও অসুবিধা নেই। তবে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করা ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। নির্বাচন কমিশন ও অন্য সকলের সঙ্গে আলোচনা করে রাজ্য প্রশাসন দিনক্ষণ স্থির করবে!”
সাধারণ ভাবে আগামী বছর মে মাসেই রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট হওয়ার কথা। কিন্তু নিয়ম অনুসারে এই ভোট ছ’মাস এগিয়ে আনা যায়। সেই মতো জানুয়ারিতে ভোট করার কথা ভাবছিল রাজ্য সরকার। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি দিয়ে ভোটার তালিকা সংশোধন স্থগিত রাখার কথাও বলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব।
গোড়ায় খুব একটা সতর্ক না থাকলেও এই ঘটনার পরেই নড়েচড়ে বসে সিপিএম। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে দলের পলিটব্যুরো নেতা সীতারাম ইয়েচুরি, সূর্যকান্ত মিশ্ররা বলেন, ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ চলছে। চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশিত হবে জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে। (মুর্শিদাবাদে ২১ জানুয়ারি) এখন সেই কাজ স্থগিত রেখে ভোট করাটা ঠিক হবে না। তাতে সদ্য আঠারো ছোঁয়া বহু তরুণ-তরুণী ভোট দেওয়ার সুযোগ হারাবেন। তা ছাড়া, পঞ্চায়েতে আসন পুনর্বিন্যাসের কাজও কিছু বাকি রয়েছে। ভোট এগিয়ে আনা হলে সেই কাজও ব্যাহত হবে। রাজ্য কংগ্রেসের নেতারাও ভোটার তালিকা সংশোধন ও আসন পুনর্বিন্যাসের কাজ শেষ করে পঞ্চায়েত নির্বাচন করতে কমিশনকে অনুরোধ করেন। এআইসিসি নেতৃত্বের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন তাঁরা।
রাজ্যও নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতিনিধি পাঠায়। তৃণমূলের তরফে মুকুল রায় কমিশনের সঙ্গে কথা বলেন। কমিশনকে বলা হয়, কেন্দ্রীয় সরকার বা তাদের (নির্বাচন কমিশন) পঞ্চায়েত ভোট নিয়ন্ত্রণ করার কোনও অধিকার নেই। এ ব্যাপারে পূর্ণ ক্ষমতা রাজ্য সরকারেরই। তারাই ভোটের দিনক্ষণ ঠিক করতে পারে। সুতরাং রাজ্য যদি মনে করে জানুয়ারিতে ভোট করবে, তা হলে তত দিন পর্যন্ত সংশোধিত ভোটার তালিকার ভিত্তিতেই ভোট হবে।
পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ নিয়ে অবশ্য শাসক দলের মধ্যে অবশ্য একটা ভিন্ন মতও ছিল। পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় মনে করছিলেন জানুয়ারিতে ভোট করা অসুবিধাজনক। তাঁর যুক্তি ছিল, গ্রামে উন্নয়নমূলক প্রচুর প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। সেগুলি বাস্তবায়িত হতে সময় লাগবে। |
|
বিরোধী দলগুলি যদি আরও সময় চায়,
তাতে আমাদের কোনও অসুবিধা নেই। |
|
সুব্রতবাবুর মতে, পরে ভোট হলে গ্রামের মানুষ ওই প্রকল্পগুলির সুযোগ-সুবিধা পেতে শুরু করবেন। তাতে আখেরে তৃণমূলেরই সুবিধা হবে। তা ছাড়া, ভোটের দিনক্ষণ জারি হয়ে গেলে আদর্শ আচরণবিধির কারণে নতুন প্রকল্প ঘোষণা করাও যাবে না।
শাসক ও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে প্রশাসনিক প্রশ্ন তুলে যুক্তি পাল্টা-যুক্তি দেওয়া হলেও পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে টানাপোড়েনের আসল কারণটা রাজনৈতিক বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের মত। তৃণমূল চাইছিল, মহাকরণ দখলের রেশ থাকতে থাকতে পঞ্চায়েত ভোট করে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত ক্ষমতা দখলের কাজ সেরে ফেলতে। অন্য দিকে সিপিএমের হিসেব হল, এখন যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে রাজ্যের সর্বত্র প্রার্থী দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। কারণ জেলায় জেলায় সিপিএমের যে পেশিশক্তি ছিল, তাদের বড় একটা অংশ তৃণমূলে চলে গিয়েছে। দলীয় নেতারা মনে করছেন, হাতে কিছু সময় পেলে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা সম্ভব। ফলে ভোট জানুয়ারির বদলে মে মাসে হলে তাঁদের সুবিধা। সিপিএম নেতারা আরও মনে করছেন, হলদিয়া থেকে দুবরাজপুর নানা কারণে মমতার জনপ্রিয়তায় ক্রমশ চিড় ধরছে। ফলে পঞ্চায়েত নির্বাচন যত দেরিতে হবে, ততই তাঁদের লাভ হবে।
এই অঙ্ক মাথায় রেখেই ভোট না এগোনোর দাবিতে সরব হয় সিপিএম। দলের নেতারা গোড়ায় রাজ্যের মুখ্য নির্বাচন আধিকারিক মীরা পাণ্ডের বিরুদ্ধে তৃণমূলের হয়ে কাজ করার অভিযোগ তুলেছিলেন। কিন্তু পরে তাঁরা মনে করেন যে, নির্বাচনী আধিকারিকের সঙ্গে দেখা না করাটা কৌশলগত ভাবে ভুল হচ্ছে। তখন মীরা পাণ্ডের সঙ্গেও দেখা করে ভোট না এগোনোর জন্য তাঁর উপরে চাপ সৃষ্টি করে সিপিএম।
পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে শাসক-বিরোধী টানাপোড়েন যখন তুঙ্গে পৌঁছেছে, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স’-এর মতো রাজ্যের সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, পঞ্চায়েত ভোট যখনই হোক, তাঁর কোনও সমস্যা নেই। তিনি বিষয়টিকে সম্মানের লড়াই করারও বিপক্ষে। তিনি শুধু চান, ভোটের সময় এমন আবহাওয়া থাকুক যাতে মানুষের সমস্যা না হয়।
এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের মধ্যে থেকে এমন প্রস্তাবও আসে যে, আগামী বছর নভেম্বরে পঞ্চায়েত ভোট হোক। তত দিন পর্যন্ত যে পঞ্চায়েত যার হাতে রয়েছে, তার হাতেই থাকবে। কিন্তু সেখানে আবার সাংবিধানিক প্রশ্ন জড়িত। সেই সমস্যা অবশ্য জানুয়ারি মাসে ভোট হলেও দেখা দিত। কারণ নিয়ম অনুযায়ী, ভোট আগে হলেও মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পুরনো পঞ্চায়েতই ক্ষমতায় থাকবে। ফলে যে সব পঞ্চায়েতে ক্ষমতার রদবদল হতো, সেখানে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
এহেন পরিস্থিতিতে মমতা সিদ্ধান্ত নিলেন, অকারণ জলঘোলা করে লাভ নেই। সিপিএম, কংগ্রেস সবাই যখন সরব হয়েছে, তখন মে মাসেই ভোট হোক। হেরে যাওয়ার ভয়ে সিপিএম নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখতে চাইছে বলেও প্রচার শুরু করেছে তৃণমূল। অন্য দিকে সিপিএমের সমস্যা হল, মে মাসে নির্বাচন করতে রাজ্যকে বাধ্য করা হল বলে প্রচারের তেমন সুযোগ নেই। কারণ, কবে ভোট হবে তা নিয়ে সাধারণ মানুষ চিন্তিত নয়। তারা তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়েই বেশি চিন্তিত। সেটা বুঝেই এই দিনক্ষণ সংক্রান্ত জয় নিয়ে রাস্তায় নামছে না সিপিএম। |