একত্রিশটা রান আর!
আমদাবাদে প্রথম টেস্টেই, কিংবা ইংল্যান্ড সিরিজের যে কোনও সময় ওই রানটা করলে সচিন তেন্ডুলকর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৩৪০০০ রানে পৌঁছে যাবে। এত রান ভবিষ্যতে আর কোনও ব্যাটসম্যান কোনও দিন করবে না, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি। কারণটা হল, কুড়ি ওভারের ক্রিকেটের বহর দিন-দিন বেড়েই চলেছে।
কী করে সচিন এত রান করল? এই প্রশ্নের যদি একটাই সহজ উত্তর থাকে, তা হলে আমি বলবওর মগজের জোরে। ওর সময় তেন্ডুলকরই হল শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট-মস্তিষ্কের অধিকারী। সম্ভবত ডন ব্র্যাডম্যান-পরবর্তী ক্রিকেট যুগের সেরা মস্তিষ্ক।
ওর কিট ব্যাগে ফোরআর্ম-গার্ড আর এক জোড়া প্যাড ছাড়াও নিশ্চয়ই একটা ল্যাপটপ থাকে। যেটাকে ব্যাট করতে নামার সময় ও ওর হেলমেটের তলায় মাথার ভেতর পুরে ফেলে। ব্যাটিংয়ের যাবতীয় ফ্যাক্টরগুলোকে ওর চেয়ে ভাল ভাবে বিচার কেউ করে না বোলার, পিচ, বল, মাঠে বয়ে যাওয়া হাওয়া, মাথার ওপরের সূর্য এ সব কিছুকে তেন্ডুলকর ওর ইনিংস গড়ার সময় নিজের মাথার ভেতর প্রোগ্রামিং করে নেয়। চান্স ফ্যাক্টর ব্যাপারটাকে যতটা সম্ভব কমিয়ে ফেলে। সবচেয়ে বেশি রান করার সেরা উপায়টা নির্ধারণ করে তেন্ডুলকরের মস্তিষ্ক। |
তবে আমি হয়তো ওর ক্রিকেট-মস্তিষ্ক বুঝতে একটু দেরি করে ফেলেছিলাম। যেটা উনিশশো নব্বইয়ে ওকে প্রথম দেখার সময় বুঝিনি। যখন ওল্ড ট্র্যাফোর্ড টেস্টের শেষ দুপুরে তেন্ডুলকর কাট আর স্কোয়ার ড্রাইভ মেরে ওর প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করেছিল। তেন্ডুলকরের যে কী অসাধারণ একটা মাথা আছে সেটা বুঝেছিলাম ওকে প্রথম দেখার মাত্র বারো বছর বাদে ভারত-ইংল্যান্ড মোহালি টেস্টের সময়। এবং সেটা ওর ব্যাটিং দেখেও নয়। বরং ওই ম্যাচে ওর একটা ছোট বোলিং স্পেল দেখে। তাও যেটায় তেন্ডুলকর কোনও উইকেট পায়নি। কিন্তু সেটাই আমাকে ওর ক্রিকেট-মস্তিষ্ক নিয়ে আলো দেখিয়েছিল।
দ্রুত গতির উইকেটে ২১ ওভারের শেষে ইংল্যান্ড এক উইকেটে ৯৪ রানে পৌঁছে গিয়েছিল। বল যথেষ্ট গতিতে গেলেও ভারতের হয়ে বোলিং ওপেন করেছিল দু’জন শিক্ষানবিশ। ব্যাটসম্যানদের স্ট্রোকের জায়গা দিয়ে ফেলছিল। যার ফায়দা তুলছিল মার্কাস ট্রেসকোথিক আর নাসের হুসেন। এমনকী অনিল কুম্বলে বল করতে এলে ওর প্রথম ওভারেই ট্রেসকোথিক তিনটে বাউন্ডারি মেরেছিল।
এই সময় ভারতের বোলিংয়ে ঠিক যেটা দরকার ছিল তেন্ডুলকরের মাথা সেটাই খুঁজে বার করেছিল। প্যাভিলিয়ন প্রান্ত থেকে ও ঠিক করল স্লো-মিডিয়াম আউটসুইং করবে। যে ধরনের মিলিটারি পেস বোলিং ব্যাটসম্যানরা খেলতে অপছন্দ করে। তেন্ডুলকরের বোলিংয়ের সামনে ইংল্যান্ডের রানের গতি ধাক্কা খেয়েছিল। তেন্ডুলকর চার ওভারের মধ্যে তিনটে মেডেন নিয়েছিল। মাত্র একটা স্কোরিং শট ছিল ওই চার ওভারে। ভারত ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলল। বিপক্ষের উইকেট পড়া শুরু হল। ইংল্যান্ড অলআউট হয়ে গিয়েছিল ২৩৮ রানে। টেস্টটা ভারত জিতেছিল দশ উইকেটে।
তেন্ডুলকরের কম্পিউটার-মস্তিষ্কের আরও উদাহরণ আছে। কোনও নিয়মিত টেস্ট বোলার ওর রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। তবে এটা আমি বলছি সচিন বনাম ওয়ার্ন অধ্যায়গুলোকে বাইরে রেখে। কারণ ওটা আমার স্বচক্ষে দেখা হয়নি। ব্র্যাডম্যানের বিরুদ্ধে পর্যন্ত অ্যালেক বেডসারের ভাল রেকর্ড ছিল। কিন্তু তেন্ডুলকরের টেকনিকে কোনও খুঁত কেউ বার করতে পারেনি। কারণ, বোলারদের রহস্যভেদে ওর মস্তিষ্ক সব সময় কাজ করে এসেছে। মুথাইয়া মুরলীধরন ওকে টেস্ট ম্যাচে প্রায়ই আউট করেছে। কিন্তু সেটাও ১৯ ম্যাচে মাত্র আট বার।
যদিও ইংল্যান্ডে একটা বিরল সাক্ষাৎকারে তেন্ডুলকরকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, কোন বোলারকে খেলতে ও সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে? ওর অবাক করে দেওয়া উত্তর ছিল হ্যান্সি ক্রোনিয়ে। আমার মনে হয়, তেন্ডুলকর যাকে কখনও খেলেনি এবং ওর ভেতরের কম্পিউটার যে বোলারের আগাম রহস্যভেদ করে রাখেনি, সে রকম কোনও অনিয়মিত বোলার ওকে হয়তো চমকে দিতে পারে। মুরলী বা ওয়ার্নকে সামলানোর প্রোগ্রামিং ওর করা আছে। কিন্তু মার্কাস নর্থ বা মাইকেল ভন কিংবা জ্যান্ডার ডার ব্রুইন অথবা প্রয়াত ক্রোনিয়ের বোলিং নিয়ে নয়।
ভারতের এই দলেও চোখ আর হাতের দ্রুত কো-অর্ডিনেশনে খেলা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তেন্ডুলকর সেরা নয়। সেই ঘটনাটার কথা আমরা তো সবাই জানি। যখন ক্রিকেটজীবনের একেবারে শুরুর দিকে মুম্বইয়ের কোচ তেন্ডুলকরকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল। কারণ, ও ওর সমবয়সিদের মতো প্রতিভাবান ছিল না।
কিংবা অন্য উদাহরণটা। ২০০১ ইংল্যান্ড সিরিজের শেষের দিকে ওর বিরুদ্ধে বাঁহাতি স্পিনার অ্যাশলে জাইলস ওভার দ্য উইকেট আসত। এবং বেঙ্গালুরু টেস্টে ওই ভাবে এসে জাইলস লেগস্টাম্পের বাইরের রাফ-এ বল ফেলে তেন্ডুলকরকে অনেকটাই বেঁধে রেখেছিল। অথচ বীরেন্দ্র সহবাগ ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে জাইলসকে কখনও সোজা কখনও লং-অনে ফেলে দিয়েছিল। যেটা অবশ্যই ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন শট। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সহবাগ বা অন্য যে কোনও ব্যাটসম্যানের থেকে তেন্ডুলকর অনেক বেশি রান করেছে ওর ক্রিকেট-মস্তিষ্কের জোরে। ওর চোখ আর মাথার দ্রুত কো-অর্ডিনেশনের সৌজন্যে।
প্রচুর রান করার বাইরেও তেন্ডুলকর ভারতের হয়ে সেটাই করেছে যেটা পন্টিং করেছে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে। বা জাক কালিস করেছে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে। কিংবা ব্রায়ান লারা করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে। তবে আমাদের যদি তুলনা টানতে হয়, তা হলে নিরপেক্ষ ভাষ্যকাররা ব্র্যাডম্যান-যুগের পর ভিভ রিচার্ডসকেই সেরা ব্যাটসম্যান বাছবে।
পন্টিং আর কালিসের মতোই লর্ডস টেস্টে তেন্ডুলকর কোনও দিন হাফসেঞ্চুরিও করেনি। সেটা অবশ্য বিরাট কিছু নয়। যেটা আসল— বড় মঞ্চে জ্বলে ওঠাটা। লর্ডসে তিরাশির বিশ্বকাপ ফাইনালে কপিলের হাতে ভিভ রিচার্ডস ধরা পড়েছিল বটে। কিন্তু সেটা বাদে লর্ডসে যে ফাইনালই হোক বিশ্বকাপ বা সমারসেটের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেটেরিচার্ডস জেগে উঠেছে। বড় ম্যাচের চাপে যখন অন্যরা কুঁকড়ে গেছে, যখন দলের সবচেয়ে বেশি রানের দরকার পড়েছে, রিচার্ডস সাধারণত সেঞ্চুরি করেছে ওই সব খেলায়।
তেন্ডুলকরের ৫১টা টেস্ট সেঞ্চুরির মধ্যে পাঁচটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ন’টা ইনিংসে। ৪৯টা ওয়ান ডে সেঞ্চুরির ভেতর চারটে কেনিয়া আর পাঁচটা জিম্বাবোয়ের সঙ্গে। রিচার্ডস সেখানে সেরা বোলারকে লক্ষ্যবস্তু করে তাকে নিয়ে পড়ত। প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধ্বংস করত। নিজের দলকে মানসিক ভাবে এগিয়ে রাখত। যদি রিচার্ডসের ব্যাটিং না দেখে থাকেন, তা হলে সেটার একটা প্রতিচ্ছবি রয়েছে গত মাসে কলম্বোয় কুড়ি ওভারের বিশ্বকাপ ফাইনালে। মার্লন স্যামুয়েলস যখন লাসিথ মালিঙ্গার চার ওভারে ৫১ রান করেছিল। কুড়ি ওভারের ক্রিকেটের ক্ষেত্রে দুর্দান্ত, ম্যাচ জেতানো ইনিংস। যেটা অবশ্যই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান মানসিকতাকে হেরো থেকে আবার জয়ীতে পাল্টে দিতে পেরেছে। গোটা জীবন ইংল্যান্ডের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও আমি সামনের এক মাসে তেন্ডুলকরকে ঠিক ও রকম ইনিংস খেলতে দেখতে চাইব। ধরা যাক ইংল্যান্ডের জোরে বোলাররা কয়েকটা উইকেট তুলে নিয়েছে। তেন্ডুলকর যখন ক্রিজে এল, তখন গ্রেম সোয়ান উইকেট থেকে টার্ন পাচ্ছে। তা সত্ত্বেও ২০১১ সিরিজে ইংল্যান্ড যেমন ওর ওপর প্রাধান্য দেখিয়েছিল। বিশেষ করে লর্ডসে ওর দ্বিতীয় ইনিংসে (৬৮ বলে ১২ রান), তার কাউন্টার অ্যাটাক এ বার তেন্ডুলকর করবে। সোয়ানকে মাঠের বাইরে উধাও করে দিয়ে। বোলারদের শাসন করে প্রমাণ করে দেবে আসল মাস্টার কে! |