এ শহরের ১৮তম চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন করতে এসে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম শ্রদ্ধাভরে উল্লেখ করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন। অথচ সেই অনুষ্ঠানে ছিলেন না সৌমিত্রই। সোমবার সৌমিত্র নিজে অমিতাভর বক্তৃতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কিন্তু উৎসব-মঞ্চের বাকি পরিবেশ সম্পর্কে তাঁর আপত্তি রয়েছে বলে জানিয়েছেন।
রবিবারই সিনে সেন্ট্রালের চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে দাঁড়িয়ে সৌমিত্র বলেছিলেন, “চলচ্চিত্র উৎসব কোনও সার্কাস বা কার্নিভাল নয়!” সোমবারও সেই মন্তব্যের রেশ টেনে সৌমিত্র বলেন, “একমাত্র অমিতাভ বচ্চনের বক্তৃতা ছাড়া কোনও কিছুই এই আন্তর্জাতিক উৎসবের মর্যাদার সঙ্গে খাপ খায়নি। অমিতাভের শিক্ষা-দীক্ষা, কলকাতা ও চলচ্চিত্রের বিষয়ে হোমওয়ার্ক অসাধারণ।”
তা হলে আপত্তি কী নিয়ে? বাম আমলে চলচ্চিত্র উৎসবের সংগঠক কমিটির অন্যতম পুরোধা সরাসরি আঙুল তুলেছেন, একটি বাণিজ্যিক ছবির রিলিজ উপলক্ষে কলকাতায় আগত শাহরুখ খান ও তাঁর দুই নায়িকা, ক্যাটরিনা কাইফ ও অনুষ্কা শর্মার দিকে। তিনি বলেন, “শাহরুখ ও তাঁর দলবলের এ ভাবে মঞ্চে হাজির থাকাটা ভাল লাগেনি। ওঁরা চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চটা ব্যবহার করেছেন।” নেতাজি ইন্ডোরে অনেক বেশি দর্শক ছবি দেখার সুযোগ পেলেও সৌমিত্রের মতে, অনুষ্ঠানের ঝোঁকটা চলে গিয়েছিল মুম্বইয়ের তারকাদের দিকে। তাই শাহরুখ-অমিতাভরা চলে যেতেই স্টেডিয়াম অনেকাংশে ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। |
গত বছরের চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে সৌমিত্রকে দেখা গিয়েছিল। এ বার উদ্বোধনে থাকলেন না কেন? তাঁর বক্তব্য, “সে বার গিয়েছিলাম আমার সহকর্মী-শিল্পীদের কারও কারও অনুরোধে।” এ বার তাঁকে আমন্ত্রণ করা সত্ত্বেও তিনি আসেননি বলে সরকারি মহলের মত। কিন্তু যে ভাবে তাঁকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে তা যথাযথ নয় বলে ঘনিষ্ঠ মহলে অভিমান প্রকাশ করেছেন সৌমিত্র। যদিও সরকারি তরফে বক্তব্য, তথ্য-সংস্কৃতি সচিব নিজে ফোন করে আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দিয়েছিলেন। এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “অন্য সব বিশিষ্ট অতিথিকে যে ভাবে ডাকা হয়েছিল, সৌমিত্রকেও সে ভাবেই ডাকা হয়েছে।” উৎসবের কমিটির সদস্য, হরনাথ চক্রবর্তী বলেন, “সৌমিত্রবাবু তো জানিয়েছিলেন, উদ্বোধনের সন্ধ্যায় তাঁর নাটক আছে। তাঁকে সচিব-পর্যায়ের এক জন মহাকরণ থেকে ফোন করেন। বাড়িতে কার্ড পাঠানো হয়।” তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের তরফেও এর সমর্থন মিলেছে।
ঠিক কী ভাবে তাঁকে আমন্ত্রণ করা সঙ্গত হত, তা নিয়ে সৌমিত্র অবশ্য মুখ খুলতে চাননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের খবর, গত জুলাইয়ে সায়েন্স সিটিতে উত্তমকুমারের তিরোধান দিবসে তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময়ে এক জন সাংসদ নিজে গিয়ে গাড়িতে করে তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন। এ বার অমিতাভ বচ্চনকে ইন্ডোরে নিয়ে আসার দায়িত্ব রাজ্য মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্য সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সৌমিত্রর আরও অভিমান ছিল, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ থাকলেও উৎসবে ছবি দেখার আমন্ত্রণপত্র পাননি তিনি। উৎসব শুরু হয়ে যাওয়ার দু’দিন বাদে সোমবার সকালে তাঁর কাছে ছবি দেখার কার্ড এসে পৌঁছেছে।
প্রবীণ চিত্রপরিচালক মৃণাল সেন অবশ্য আমন্ত্রণের ধরন নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলেননি। তবে তিনিও অনুুপস্থিত ছিলেন উদ্বোধনে। অমিতাভর বক্তৃতায় মৃণালবাবুর কথাও ছিল। ‘ভুবন সোম’ ছবিতে নেপথ্য ভাষ্যে অমিতাভর গলা ব্যবহার করেছিলেন মৃণাল।
এ বারের উদ্বোধনে
অমিতাভের বক্তৃতা ছাড়া আর কিছুই ভাল লাগেনি মৃণালবাবুরও।
বললেন, “উদ্বোধনী ছবিটি দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু অত বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আগ্রহ নেই।
তাই যাইনি।”
পরিবেশগত এই সমালোচনা কিছুটা হলেও মেনে নিয়েছেন উৎসবের টেকনিকাল কমিটির কর্তা গৌতম ঘোষ। তাঁর বক্তব্য, “উদ্বোধনী ছবিটি অনেক দর্শককে দেখার সুযোগ করে দিতেই অনুষ্ঠান নেতাজি ইন্ডোরে সরানো হয়। তখন আমজনতার ভাল লাগবে এমন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথাও ভাবা হয়।” গৌতমের মতে, সর্বভারতীয় তারকারা এলে উৎসবের প্রচার বাড়ে। “উৎসবে নিরীক্ষামূলক ছবি ও বাণিজ্যিক ছবির ধারার সমন্বয় সাধন তো ভালই।”
অনুষ্ঠান নিয়ে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি যা-ই থাকুক, সৌমিত্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে না-থাকার পিছনে কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তৃণমূল সরকারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের
শৈত্যই বড় কারণ বলে মনে করছেন অনেকে। সৌমিত্র বা মৃণালবাবু প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ বলে গণ্য হতেন। সে কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্টদের বঙ্গবিভূষণ সম্মান চালু করলেও সৌমিত্র-মৃণাল তা পাননি বলে মনে করা হয়। এ বছর উত্তমকুমারের তিরোধান দিবসে মমতার সরকার সৌমিত্রকে সম্মানিত করলেও দু’তরফে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি। |