খাবার সরবরাহকারীদের দরপত্র ডাকা নিয়ে এক দিকে স্বাস্থ্য দফতরের গড়িমসি, অন্য দিকে সরকারি মানসিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গোঁ— দুইয়ের মাঝে পড়ে আক্ষরিক অর্থে ‘ভাতে মরছেন’ কলকাতার পাভলভ মানসিক হাসপাতালের রোগীরা।
অবস্থা এতটাই খারাপ যে, রোগীদের বরাদ্দ বিকেলের জলখাবার বন্ধ করে দিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাঁদের জন্য সকাল-বিকেল ভাতের পরিমাণ বাড়ানোর যে সরকারি নির্দেশ ছিল, তা-ও মানা হবে না বলে সোজাসুজি ঘোষণা করেছেন পাভলভের সুপার। রোগীদের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হাসপাতালের চিকিৎসকদেরই একাংশ স্বাস্থ্যভবনে অভিযোগ জানিয়েছেন, গন্ধ হয়ে যাওয়া ভাত, পাতলা ডাল আর খাবার অযোগ্য বাসি শাকসব্জি খেয়ে প্রতি সপ্তাহে একাধিক রোগী পেটের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাঁরা আরও জানান, মানসিক রোগীদের এমনিতেই খিদে বেশি পায়। সেই কারণেই তাঁদের জন্য বিকেলের জলখাবার বরাদ্দ হয়েছিল। বাড়ানো হয়েছিল ভাত। সাধারণ হাসপাতালে এটা দেওয়া হয় না। কিন্তু পাভলভ কর্তৃপক্ষ সেই খাবার বন্ধ করে দেওয়ায় রোগীদের সুস্থ হওয়ার প্রক্রিয়াই ধাক্কা খাচ্ছে।
পুজোর মুখে ওই হাসপাতালে সুস্থ হয়ে ওঠা কয়েক জন রোগী নিজেদের হাতে লিখে এবং সই করে একটি প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কাছে। তাতে তাঁরা লিখেছেন, বিকেলে জলখাবার হিসেবে মুড়ি, চিঁড়ে বা চাউমিন জাতীয় খাবার দেওয়ার কথা। তা পুরো বন্ধ। বেলা সাড়ে এগারোটা-বারোটা নাগাদ দুপুরের খাওয়া শেষ হওয়ার পরে রাত পর্যন্ত এক কাপ চা ছাড়া আর কিচ্ছু জুটছে না তাঁদের। খিদে চেপে থেকে অনেকেই গ্যাসট্রাইটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন।
এই অবস্থা কেন? কারণ খুঁজতে গিয়ে সামনে এসেছে দফতরের অভ্যন্তরীণ নিয়মনীতির ফাঁক এবং দ্বন্দ্বের কথা।
২০১১ সালের অগস্ট মাসে স্বাস্থ্য দফতর তাদের সব হাসপাতালের জন্যই রোগী-পথ্যের টাকার বরাদ্দ বাড়ায়। সেই সময়ে ‘সাইকিয়াট্রি ডায়েট’ নামে নতুন একটা ডায়েট চালু করা হয় মানসিক হাসপাতালের রোগীদের জন্য। এর জন্য মাথাপিছু ৬০ টাকা ৫২ পয়সা ধার্য করা হয়। তখনই মানসিক হাসপাতালে বিকেলের জলখাবার আর অতিরিক্ত পরিমাণ ভাত চালু হয়। অথচ, অজ্ঞাত কারণে এর জন্য দরপত্র ডাকতে দেরি করতে থাকে স্বাস্থ্য ভবনের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগ। বহরমপুর, পুরুলিয়া মানসিক হাসপাতাল ও এসএসকেএম সংলগ্ন ‘ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রি’-তে কর্তৃপক্ষ নিজেরাই দরপত্র ডেকে নতুন ডায়েট চালু করে দেন। কিন্তু লুম্বিনী ও পাভলভে তা করা হয়নি।
মাস চারেক আগে একটি জনস্বার্থ মামলার জেরে নতুন ডায়েট চালু করে লুম্বিনীও। তখনই স্বাস্থ্য অধিকর্তার অফিস থেকে লিখিত নির্দেশে পাভলভ কর্তৃপক্ষকে দরপত্র ডাকতে বলা হয়। কিন্তু বেঁকে বসেন পাভলভের সুপার রাঘবেশ মজুমদার। জানিয়ে দেন, স্বাস্থ্য দফতর নতুন বছরের জন্য ডায়েটের নতুন ‘রেট শিডিউল’ ঘোষণা না-করলে তিনি দরপত্র ডাকবেন না। তার পর থেকে স্বাস্থ্য দফতরও রেট শিডিউল ঘোষণা করেনি, রাঘবেশবাবুও দরপত্র ডাকেননি। আর তার জেরে আধপেটা খেয়ে রয়ে গিয়েছেন রোগীরা।
ক্ষুব্ধ স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “অন্যায় করছেন সুপার। ওঁকে যখন সরকারি ভাবে দরপত্র ডাকতে বলা হয়েছে, সেটা করতে উনি বাধ্য। ওঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।” সুপার রাঘবেশবাবুর পাল্টা জবাব, “আগে স্বাস্থ্য দফতর জবাব দিক, তারা কেন এত দিনে পাভলভের জন্য দরপত্র ডাকতে পারেনি? কেন এ বছর অক্টোবর মাস শেষ হতে চললেও ডায়েটের নতুন রেট ঘোষণা করতে পারলেন না বিশ্বরঞ্জনবাবু? তিনি যত দিন না এটা করবেন, আমিও দরপত্র ডাকব না?”
তা হলে রোগীদের কী হবে? রাঘবেশবাবু বক্তব্য, “রোগীরা বিকেলবেলা এক কাপ চা পাচ্ছে তো। ওতেই হবে। অত জলখাবারের দরকার নেই। আর এত যদি চিন্তা তা হলে শতপথীবাবু কেন সমাধান করছেন না?” পাভলভের চিকিৎসকদের একাংশ হতাশা লুকোতে না পেরে বলছেন, “পুজোর চার দিন লোক-দেখানো লুচি-তরকারি, পোলাও-মাংস খাওয়ানো হল। স্বাস্থ্য দফতর মানসিক রোগীদের কথা কতটা ভাবে, তার ফলাও প্রচার চলল। অথচ, বছরের বাকি দিন পাভলভের রোগীরা আধপেটা খেয়ে আছে, তার হিসেব কেউ রাখল না। এই প্রহসন কত দিন চলবে?” |