|
|
|
|
লক্ষ্মীছাড়া সরকার, আক্রমণ সূর্যদেরও |
সিঙ্গুর দেখছে হাইকম্যান্ড, আন্দোলনের নির্দেশ |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা ও নয়াদিল্লি |
হলদিয়া বন্দরের পরিস্থিতির সঙ্গে সিঙ্গুরের মিল পাচ্ছে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। সিঙ্গুরের সময় রাজ্য কংগ্রেস বড় ভূমিকা নেয়নি। এ বার কিন্তু এই পরিপ্রেক্ষিতে শাসক দল তৃণমূলকে আক্রমণের সুযোগ ছাড়তে চাইছেন না সনিয়া গাঁধী-মনমোহন সিংহ। বিশেষ করে রাজ্যে শিল্প-পরিস্থিতির অবনতির প্রসঙ্গ তুলে যাতে এখনই সরকার-বিরোধী আন্দোলনে নামে দল, সে জন্য রাজ্য নেতৃত্বকে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁরা। ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট। বামেদের বিশেষ সুযোগ না দিয়ে রাজ্যে বিরোধিতার পরিসরটা যতটা সম্ভব দখল করে নেওয়া। এই সরকার-বিরোধী আক্রমণ কতটা ঝাঁঝাল হবে, তার একটা ইঙ্গিত রেখে গেলেন গত কাল শপথ নেওয়া মন্ত্রীরা।
সিঙ্গুরে তৃণমূলের তীব্র আন্দোলনের ফলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যাতে ন্যানোর কারখানা গুজরাতের সানন্দে নিয়ে যেতে বাধ্য হয় টাটারা। রতন টাটা বলেছিলেন, ‘মমতা তো ট্রিগার টিপে দিলেন!’ সেই মমতা এখন শাসক। হলদিয়ায় এবিজি-কর্মীদের প্রতি এত দিন যে হুমকি-হুঁশিয়ারি চলছিল, তা সামলানোর দায়িত্ব তাঁর প্রশাসনেরই। কিন্তু শনিবার গভীর রাতে থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে আবাসন থেকে এবিজি-র তিন ম্যানেজার, এক মহিলা এবং একটি শিশুকে দুষ্কৃতীরা অপহরণ করার পরে পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে উদাসীনতার অভিযোগ উঠেছে প্রবল ভাবে। সিপিএম স্বাভাবিক ভাবেই অভিযোগ তুলেছে। তবে কংগ্রেস নেতৃত্বের সুর আরও চড়া। রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গে এখন জঙ্গলের রাজত্ব চলছে।” একই ভাবে হলদিয়া নিয়ে রাজ্য সরকার ও প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা করেছেন মানস ভুঁইয়াও। তাঁর অভিযোগ, “রবিবার যা ঘটেছে, তাতে রাজ্যে মন্ত্রী, পুলিস, প্রশাসন আছে বলে মনে হচ্ছিল না! কার স্বার্থে সরকার ও প্রশাসন এমন আধিভৌতিক নীরবতা অবলম্বন করেছে, তার তদন্ত হওয়া দরকার!” হামলাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবিও জানিয়েছেন মানসবাবু।
হলদিয়া বন্দরের পরিস্থিতির কথা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী দীপা দাশমুন্সি। পরে তিনি বলেন, “বিষয়টি জাহাজমন্ত্রী জি কে ভাসানকেও জানিয়েছি। উনি দিল্লিতে ফিরলেই হলদিয়া সংক্রান্ত কাগজপত্র ওঁর হাতে তুলে দেব। প্রধানমন্ত্রীও ওঁর সঙ্গেই কথা বলতে বলেছেন।” একই দাবি নিয়ে আগামী শুক্রবার দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ও জাহাজমন্ত্রীর কাছে দরবার করতে যাবেন কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়াও। তাঁর বক্তব্য, “হলদিয়া বন্দরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।”
অধীর আবার মনে করছেন, এই ঘটনায় দেশের শিল্পমহলের কাছে নেতিবাচক বার্তা যাবে। সিপিএমের সুরেই তৃণমূলকে দুষে তাঁর মন্তব্য, “সিঙ্গুরের পরে এই ঘটনায় শিল্প সমাজের কাছে ফের এক বার নেতিবাচক বার্তা যাবে। এক তৃণমূল সাংসদকে সুবিধা করে দিতেই সম্পূর্ণ ঘটনাটিতে নীরবতা পালন করছে রাজ্য প্রশাসন।” তাঁর অভিযোগ, “আসলে শাসক দলের হস্তক্ষেপ না থাকলে এই অপহরণ সম্ভব নয়। রাজ্য সরকারের উচিত অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া।”
কংগ্রেসের সুরে শাসক দলকে আক্রমণ করেছে সিপিএমও। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেছেন,“লক্ষ্মীছাড়া সরকার চলছে! অবাক লাগছে, রাজ্য সরকার নীরব ভূমিকা পালন করছে! আর তৃণমূল হনুমান টুপি পরে এই সব আক্রমণ করছে!” হলদিয়া বন্দর ছেড়ে এবিজি চলে গেলে আখেরে রাজ্যের অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে বলেই মনে করছেন সিপিএম তথা সিটু নেতৃত্ব। সিটুর রাজ্য সভাপতি তথা সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তীর অভিযোগ, “যে ২৭৫ জনকে কাজে নেওয়া নিয়ে গণ্ডগোল হচ্ছে, তারা অন্য জায়গায় কাজ করত। এবিজিকে কাজ করতে না-দেওয়ার জন্যই ইচ্ছাকৃত ভাবে এদের কাজে নেওয়ার দাবি তোলা হচ্ছে।” শ্যামলবাবু জানান, যখন গ্লোবাল টেন্ডার ডেকে এবিজি-কে নিয়োগ করা হয়েছিল, তখনই ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী কর্মরত ৩৫০ জন শ্রমিককে এবিজি কাজে নিয়েছিল। এবিজি চলে গেলে এরা সবাই বেকার হয়ে পড়বে। অন্য দিকে, এবিজি-কে নির্ধারিত সাড়ে ৮ কোটি মেট্রিক টন মাল খালাস করতে দিলে তারা অতিরিক্ত ২৭৫ জনকেও কাজে নিতে পারে। গত বছর হলদিয়ায় ৩৪৪টি জাহাজ কম এসেছে এ কথা জানিয়ে শ্যামলবাবু বলেন, “এমন চললে অবস্থা আরও খারাপ হবে।”
তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য হলদিয়া নিয়ে বিশদে কিছু বলতে নারাজ। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এ দিন দিল্লি থেকে বলেন, “আমি এখন রাজ্যের বাইরে। কিছু বলতে পারব না।” তবে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য সভানেত্রী দোলা সেনের দাবি, তাঁদের সংগঠনের নামে ডাহা মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে। তিনি বলেন, “হলদিয়ায় যে সময়ে বাড়তি কর্মী ঢোকানো হয়েছিল, তখন সেখানে আমাদের সংগঠন ছিল না। সিপিএমের লক্ষ্মণ শেঠের দাপটে গায়ের জোরে লোক ঢোকানো হয়েছিল। এখন ছাঁটাইয়ের সময়ে কেন তৃণমূলের কাঁধে বন্দুক রাখা হচ্ছে?” তাঁর পাল্টা অভিযোগ, “নিজাম প্যালেসে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, কর্মী ছাঁটাই হবে না। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তও মানা হচ্ছে না। নির্বিচারে ছাঁটাই করা হচ্ছে।” ঘটনাপ্রবাহেই ইঙ্গিত, তৃণমূলও সহজে হলদিয়া থেকে সরবে না। আর তাতেই অনেকে সিঙ্গুরের মেঘ দেখছেন হলদিয়াতেও! |
|
|
|
|
|