ভারত ইতিহাসের চর্চাকারী উইলিয়ম ডালরিমপল বলিয়াছেন, ভারতে সরকারি সংগ্রহশালাগুলির অবস্থা শোচনীয়। বিদেশিরা ভারতের অবস্থা ও ব্যবস্থা লইয়া কিছু বলিলেই আমরা বিচিত্র প্রতিক্রিয়া দেখাইয়া থাকি। হয় তাহার কথা একেবারেই ফেলিয়া দিই, না হয় বেশ করিয়াছেন ভাল বলিয়াছেন বলিয়া দ্বিগুণ বা তিনগুণ স্বজাতিনিন্দা করি। সাহেবদের কথা বলিয়া ফেলিয়া দিলে আত্মসংশোধনের প্রশ্নই উঠে না। আর সাহেবদের কথা বলিয়া মাথায় করিয়া রাখিয়া স্বদেশসমালোচনার নিনাদে যাঁহারা চতুর্মুখ হইলেও কিছুই বদলায় না। ফল একই। সেই তিমির।
ডালরিমপলের কথা সত্য। হাতের কাছের যে কোনও সরকারি সংগ্রহশালায় ঢুকিয়া দেখুন, অবস্থা কম-বেশি একই প্রকার। প্রদর্শবস্তুগুলি মলিন, কোথাও কোথাও আলো জ্বলিতেছে না। যদি বা আলো জ্বলে বিষয় বুঝাইবার জন্য উপযুক্ত গাইড নাই। যদি বা গাইড পাইলেন, তাঁহার কথার পারম্পর্য নাই। মোটের উপর এক বার সেখানে ঢুকিলে পুনরায় আর যাইবার ইচ্ছা জাগিবে না। সরকারি কর্মীরা যাঁহারা দায়িত্বে রহিয়াছেন তাঁহারাও সম্ভবত প্রচুর উৎসাহী পর্যটকের আগমন কামনা করেন না। তাহার চাহিতে ইহাই তো বেশ ভাল: লোকজনকে আকর্ষণ করিবার ব্যবস্থা ও অবস্থা নাই। সংগ্রহশালাগুলি রহিয়াছে, কর্মীদের মাসিক বেতনও পাওয়া যাইতেছে। মাঝে মধ্যে যাঁহারা আসেন তাঁহারা নিজেদের দায় ও দায়িত্বে যাহা দেখিবার দেখিয়া লইতে বাধ্য হন। নেহরুর জমানায় এই জাতীয় সংগ্রহশালাগুলি যখন গড়িয়া উঠিতেছিল তখন বরং সদ্য-স্বাধীন দেশে জাতীয়তাবাদী আবেগ অবস্থাকে কিছু উন্নত রাখিয়াছিল। আবেগ ও আবেশ ক্রমে মজিয়া গিয়াছে।
কী করণীয়? প্রদর্শশালা ও সংগ্রহশালাগুলির উদ্দেশ্য কী আগে তাহা বুঝিতে হইবে। যে সংগ্রহশালাগুলি বা সংগ্রহশালার যে কক্ষগুলি সর্বসাধারণের জন্য নহে সেগুলিকে সে ভাবেই রাখিতে হইবে। দুর্মূল্য প্রদর্শবস্তুগুলিকে সযত্নে রক্ষা করা আবশ্যক। সেগুলির দুর্মূল্যতা বিষয়ে নানা কথা কৌতূহলী জনগণের মধ্যে সচিত্র বিতরণের জন্য পুস্তিকাকারে প্রকাশ করা যাইতে পারে। আর যে সংগ্রহশালাগুলি সর্বসাধারণের বিনোদন ও কৌতূহলনিবৃত্তির জন্য নির্মিত তাহাদের সে ভাবেই সজ্জিত করিতে হইবে। সংগ্রহশালাগুলি জনইতিহাসের ও জনসংস্কৃতির পরম্পরা রক্ষার জন্য গড়িয়া উঠিয়াছিল। সাধারণ মানুষ যদি এই সংগ্রহশালায় না আসেন তাহা হইলে এই পারম্পর্য বিনষ্ট হইবে। বিদেশে সংগ্রহশালাগুলি যথার্থই সজীব। জনসমাবেশে স্পন্দিত। প্রতি বছরই সেখানে নিত্য নূতন প্রদর্শ ও বিন্যাসের আয়োজন চোখে পড়ে। জনগণের রুচির সাম্প্রতিকতাকে মাথায় রাখিয়া এই আয়োজন। সংগ্রহশালা বলিয়া মান্ধাতা আমলের সামগ্রী একই ভাবে ধারণ করিয়া থাকিবে কেন? ভারতের ন্যায় দেশে শিক্ষালয়ের বাহিরে যে বিপুলসংখ্যক ভারতীয়ের বসবাস, তাঁহাদের জীবনে সংগ্রহশালার ভূমিকা যথার্থই গুরুত্বপূর্ণ হইতে পারে। কিন্তু সে জন্য তাহাদের যথাযথ সংস্কার চাই। |