|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
টাকার গাছ, কারও নেই, কারও আছে |
যাঁরা সাধারণ মানুষ, তাঁদের নেই। যাঁরা অ-সাধারণ তাঁদের ঐশ্বর্য এবং ব্যয়বাহুল্য দেখলে মনে হয়,
তাঁদের টাকা গাছেই ফলে। প্রাজ্ঞ প্রধানমন্ত্রীকে কথাটা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। অশোক মিত্র |
প্রধানমন্ত্রী মহোদয় কিছু দিন আগে ঈষৎ অধৈর্যের সুরে দেশবাসীর কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের উপর, সারের উপরও সরকার ভর্তুকির পরিমাণ কমানোর সিদ্ধান্তে দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল, তাতে প্রধানমন্ত্রী বিক্ষুব্ধ হন। ভর্তুকি হ্রাসের কারণে মানুষজনের বাড়তি অসুবিধা হবে ঠিকই, তবে সরকারের দিকটাও তো সবাইকে ভাবতে হবে। অনুদানের জন্য সরকারকে টাকার ব্যবস্থা করতে হয়, কিন্তু টাকা তো গাছে ধরে না, উপায় কী!
অতি প্রচলিত বুকনি, টাকা গাছে ধরে না। প্রধানমন্ত্রী নতুন কিছু বলেননি, এবং তাঁর বক্তব্যের শাঁসটুকু অবশ্যই সর্বজনগ্রাহ্য। টাকা গাছে ধরে না। টাকা যে গাছে ধরে না, সে বিষয়ে অভিজ্ঞতম ভারতবর্ষের এক পঞ্চমাংশ কিংবা তারও কিছু বেশি অধিবাসী, যাঁরা তথাবর্ণিত দারিদ্রসীমার নীচে নির্বাসিত, যাঁরা সুস্থ-সমর্থ হয়ে বেঁচে থাকার মতো অন্নের সংস্থান করতে অপারগ। তাঁদের পর্যাপ্ত উপার্জন নেই তাই পেট ভরে খেতে পান না। তাঁদের টাকার অভাব, টাকা গাছে ধরে না। একই অভিজ্ঞতা সারা দেশ জুড়ে যে কোটি কোটি মানুষ হন্যে হয়ে কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের। যে কোনও ধরনের কাজের সংস্থান হলে তাঁদের খানিকটা উপার্জন হয়, যার উপর ভর করে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁরা টিকে থাকতে পারেন। অথচ উদারীকরণ নীতি চালু হওয়ার পর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার সঙ্কুচিত, কাজের সুযোগ নেই, উপার্জন নেই, সামান্য স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে বেঁচে থাকার উপায় নেই, হাতে টাকা আসছে না বলেই এই কোটি কোটি মানুষ এত দুর্দশাগ্রস্ত, টাকা গাছে ধরে না।
গ্রামাঞ্চলে দৃষ্টি ফেরানো যাক। স্বাধীনতা পরবর্তী কয়েক দশকে কৃষি ব্যবস্থা প্রসারের জন্য সরকার বিবিধ উদ্যোগ নিয়েছিল, যার প্রত্যক্ষ পরিণামে কৃষি উৎপাদনে শতাব্দীর স্থবিরতা দূর হয়, ব্যাপক ভূমিসংস্কার ছাড়াই উৎপাদনে কিছুটা অগ্রগতি ঘটে। এই ক্ষেত্রেও উদারীকরণের থমথমে ছায়া ঘনীভূত। আর্থিক নববিধানের ফরমান মেনে কৃষিতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ কমিয়ে আনা হচ্ছে। সরকারি নজরদারি আইনশৃঙ্খলা ও দেশের প্রতিরক্ষাতেই সীমাবদ্ধ থাক না কেন, তার বাইরে কেন ছড়ি ঘুরোনো? সমস্যা হল, যে সব শর্ত পালিত হলে পুঁজিপতিরা কৃষিতে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন সে সমস্ত মানতে গেলে সরকারের রাজনৈতিক বিপত্তিতে পড়বার আশঙ্কা। আরও মস্ত সমস্যা, উৎপাদিত নানা কৃষিপণ্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কেনার প্রতিশ্রুতিও সুষ্ঠু ভাবে পালিত হচ্ছে না। কৃষক শস্যের যথাযোগ্য দাম পাচ্ছেন না, অভাবে পিষ্ট হচ্ছেন, হতাশায় কখনও আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। |
|
মুর্দাবাদ। কেন্দ্রীয় আর্থিক নীতির প্রতিবাদে বিক্ষোভ। অমৃতসর, অক্টোবর ২০১২। ছবি: এ এফ পি |
দেশবাসীর অন্তত তিন-পঞ্চমাংশ এখনও কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষিজীবীদের একটি বড় অংশ পর্যাপ্ত টাকা হাতে পাচ্ছেন না, টাকা গাছে ধরে না। একই কাহিনি দরিদ্র ছোট চাষি ও ভূমিহীন কৃষকদের ক্ষেত্রে, তাঁরা যাতে না খেয়ে মারা যান, তা রোধ করতে জাতির মহান নেতানেত্রীদের নামে গ্রামীণ কর্মোদ্যোগ ঘোষণা করা হয়। অথচ কর্মসূচি পরিচালনের জন্য যথেষ্ট টাকা বরাদ্দ করা হয় না। সরকারের নাকি টাকার অভাব! টাকা গাছে ধরে না।
ইত্যাকার ভারী ভারী বর্ণনার কি আদৌ প্রয়োজন আছে? স্বাধীনতার পর পঁয়ষট্টি বছরেরও বেশি অতিক্রান্ত, সকাল-সন্ধ্যায়-ঘোর দ্বিপ্রহরে রাস্তাঘাটে অতি সাধারণ দৃশ্য: ঝাঁকামুটে, কাঁধে মস্ত বস্তা, সারা শরীর বেয়ে দর দর করে ঘাম ঝরছে, শরীরটাকে কোনও ক্রমে টেনে-হিঁচড়ে গন্তব্যে পৌঁছবার প্রয়াসে মানুষটি নিমগ্ন। মাল পৌঁছে দিতে পারলে তবেই দুটো টাকা আসবে, তাঁর পরিবার সামান্য দু’মুঠো খেয়ে বাঁচবে। কিংবা এক বার সেই মহিলার কথা ভাবুন, যিনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কোনও প্রত্যন্ত গ্রামে জরাজীর্ণ কুটিরে অক্ষম চিররুগ্ণ স্বামী ও তিন-চারটি সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালনে হাবুডুবু খাচ্ছেন। ভোর চারটেয় উঠে পড়ে গার্হস্থ্যের ন্যূনতম কর্তব্যাদি সেরে, রান্নার পাট চুকিয়ে, স্বামীর প্রাথমিক পরিচর্যার ব্যবস্থা করে, সন্তান ক’টির জন্য টুকিটাকি কিছু কর্তব্য সম্পন্ন করে যাঁকে বজবজ বা লক্ষ্মীকান্তপুরের লাইন ধরে শহরে আসতে হয়, সকাল সাতটার মধ্যে বাবুদের ফ্ল্যাটে পৌঁছে যেতে হয়, তার পর দিনভর অন্যতর পরিবেশে জীবিকার জন্য পরিশ্রম, গোধূলিলগ্নে ফের দমবন্ধ করা ভিড় ঠেলে ট্রেনে চেপে ঘন হওয়া নিশিতে গ্রামে-গৃহে প্রত্যাবর্তন, দিনের পর দিন, দিনের পর দিন। এই মহিলার নিজের দিকে নজর দেওয়ার অবসর নেই, সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁর এ ধরনের দিনাতিপাত না করে উপায় নেই, তাঁকে অর্থ উপার্জন করতে হবে। ওই ঝাঁকামুটের যেমন টাকার প্রয়োজন, এই শ্রমজীবী মহিলারও তেমনটিই। টাকা যে গাছে ধরে না তা জ্ঞাত হওয়ার জন্য তাঁদের প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত বেতারভাষণের বাণী শোনার দরকার নেই। যদি মোটা দাগের হিসেবও কষা যায়, দেশের অন্তত আশি শতাংশ মানুষ প্রতি মুহূর্তের অভিজ্ঞতায় এই সত্যটুকু মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে থাকেন, টাকা গাছে ধরে না। প্রধানমন্ত্রীর উক্তি, তাঁদের কাছে, দেশজ ভাষায় যাকে ‘ফালতু’ বলা হয়, স্রেফ তা-ই শুধু নয়, অপমানব্যঞ্জকও।
অথচ চোখ না কচলে উপায় নেই, মুম্বই, দিল্লি এমনকী আমাদের পিছিয়ে পড়া কলকাতাতেও সন্ধ্যা নামলেই আলো ঝলমলে বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে পরমাশ্চর্য দৃশ্য। হোটেল, নৈশক্লাব, বার, রেস্তোরাঁ; একটি বিশেষ শ্রেণিভুক্ত বিভিন্ন বয়সের ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা পিলপিল করে ঢুকছেন, ভিড় জমাচ্ছেন, রাত্রি যত প্রগাঢ় হয় ভিড় তত উৎসব-উচ্ছল, নৃত্যগীতের বন্যা, পানীয়ের ফোয়ারা, খাদ্যসামগ্রীর সমারোহ। দেশি-ভিন্দেশি অতি মহার্ঘ বিভিন্ন পানীয়ের সম্ভার, খাদ্যতালিকার আন্তর্জাতিকতা হতচকিত করে দিতে বাধ্য। এই অভিজাত প্রমোদবিলাসীরা হয়তো সব মিলিয়ে ঘণ্টা তিন-চার প্রতি সন্ধ্যায় বিনোদনে বিহার করেন। বিল চুকোবার সময় অবলীলাক্রমে ক্রেডিট কার্ডে লক্ষাধিক টাকার অঙ্ক সই করে নিষ্ক্রান্ত হন। তাঁদের ক্ষেত্রে টাকা যেন যথার্থই গাছে ধরে।
ধন্দে না পড়ে উপায় নেই, এত আপাত সহজে এত টাকা কিছু কিছু বিশেষ গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ কী করে নাগালে পেয়ে যান। উদাহরণের তালিকা লম্বা করা সম্ভবত অপ্রয়োজনীয়, তা হলেও বলি, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ নামে যে আজব ক্রিকেট ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আপাতত রমরমা, তাতে অংশগ্রহণকারী দলগুলির মালিকদের বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে সংবাদমাধ্যম সূত্রে কিছু তথ্য সাধারণের গোচরে আসে। জনৈকা একটি দলের স্বত্বাধিকারী হওয়ার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ। জানা গেল, তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই। জনৈকা কিন্তু সেই সঙ্গে বেশ ক’টি ব্যবসায়ী কিংবা শিল্পসংস্থার পরিচালকমণ্ডলীর সদস্যা। তিনি সাংসদও। তদুপরি এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দুহিতা। কিংবা যে কোনও সাদামাটা এক ধরনের রাজনৈতিক নেতার কথাই ধরুন, যিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা দলের সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে নিযুক্ত। দল থেকে ভাতা পেতেন। বিধায়ক হয়েছেন, রাজ্যস্তরে মন্ত্রীগিরি করেছেন, পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বে পৌঁছেছেন, দল যে বার পরাজিত হয়েছে, দলের কোনও গূরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব সামলেছেন, ভাগ্য পরিবর্তন হলে ফের মন্ত্রী হয়েছেন, প্রবীণ মন্ত্রী, অভিজ্ঞ মন্ত্রী। ফের নির্বাচনের ঋতু, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী আয়-ব্যয় সম্পত্তির বিশদ বিবরণ এখন থেকে অবশ্যপ্রকাশ্য। দেখা গেল, মন্ত্রী মহোদয়ের স্ব-গ্রামে পাকা বাড়ি, স্ব-রাজ্যের রাজধানীতে বিভিন্ন অঞ্চলে গোটা তিনেক ফ্ল্যাট, মুম্বই শহরেও শৌখিন পাড়ায় মহার্ঘ আবাসন, হায়দরাবাদেও, সেই সঙ্গে দিল্লির অদূরে খামারবাড়ি, ব্যাঙ্কে জমা থাকা কয়েক কোটি টাকা। হয়তো একেই বলা হয় মাদারি কা খেল। ভদ্রলোকের জীবনব্যাপী বৃত্তি হয় সর্বক্ষণের যৎসামান্য-ভাতা পাওয়া রাজনৈতিক কর্মী, নয়তো সীমিত বেতনের মন্ত্রীগিরি, কিন্তু তাঁর বিষয়সম্পত্তির পরিমাণ চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ভদ্রলোকের নিশ্চয়ই টাকার গাছ আছে, টাকা গাছে ধরে!
কল্পনাকে একটু প্রসারিত করলেই কী করে কারও কারও ক্ষেত্রে টাকা গাছে ধরে, সেই প্রকরণটির রহস্য ভেদ করা সম্ভব। উদারীকরণ নীতি প্রবর্তনের পর শিল্পপতিদের অবশ্য এমনিতেই রমরমা, এক দিকে তাঁদের মুনাফা তথা উপার্জন বিদ্যুৎগতিতে বেড়েছে, সদয় সরকার তাঁদের উপর করের বোঝা বাড়ানোর পরিবর্তে আরও কমিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া সরকার ও ধনিক শ্রেণির মধ্যে সৌহার্দ্য যত নিবিড় হয়েছে, সরকারি ক্রিয়াকমের্র মধ্যবর্তিতায় একটি বিশেষ স্তরে মানুষজনের অবলীলায় অঢেল অর্থ উপার্জনের সুযোগ তত উন্মুক্ততর হয়েছে। একটি অত্যাশ্চর্য খুড়োর কল এখন আবিষ্কৃত: খনি থেকে কয়লা উত্তোলন, কিংবা তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন তথা পরিশোধন ও বিক্রির অথবা সেল ফোন বিতরণের অধিকার সরকার থেকে পাইয়ে দিতে সাহায্য করলেন, তাঁদের যেমন হঠাৎ টাকার গাছ গজাল, যাঁরা এই কলের উত্তোলন-বণ্টন-বিনিময়-বিক্রয়ের অধিকার পেলেন তাঁদের জন্য স্বর্গ থেকে যেন অর্থের ঘন অরণ্য পুষ্পবৃষ্টির মতো বর্ষিত হতে থাকল। একই জাদু সক্রিয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সংবেদনশীল ব্যয়বরাদ্দের ক্ষেত্রেও। ‘দস্তুরি’ নামক সনাতন প্রথাটি বিচিত্র বিভঙ্গে আপাতত ক্রীড়াচঞ্চল, বিশেষ সংস্থানে গ্যাঁট-হয়ে-বসা ক খ বা গ-কে কোনও না কোনও ভাবে খুশি করতে পারলে গাছে টাকা আর ধরে না, করুণ করে গ্রহণ করলেই হল।
এখানেই খটকা, যাঁদের যাঁদের ক্ষেত্রে টাকা গাছে ধরেই চলেছে, ধরেই চলেছে, পরম দয়ালু সরকার তাঁদের রাশ টানবার কোনও চেষ্টাই করছে না, বরঞ্চ তাঁদের প্রতি আরও উদারহস্ত হচ্ছে। অথচ দেশের অধিকাংশ মানুষ অর্থাভাবে বিশীর্ণ, সংসার চালাতে তাঁরা হালে পানি পাচ্ছেন না, ডিজেল তেল কিংবা রান্নার গ্যাসের ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমানোয় বড়লোকেদের গায়ে যদিও অতি সামান্য আঁচড়ই পড়বে, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্রতর শ্রেণিভুক্তদের ওপরই বোঝা আরও অনেক বেশি করে চাপবে।
তাঁদের নিরিখে প্রধানমন্ত্রী ঘোর একচোখামি ব্যাধিতে ভুগছেন। সম্ভবত কাণ্ডজ্ঞানহীনতাতেও। নিত্য বর্ধমান দৈনন্দিন সংকটে মানুষজনের এমনিতেই পাগল-পাগল অবস্থা, তাঁদের আরও খেপিয়ে তোলা কেন, দগদগে ঘায়ে নুন ছিটিয়ে কেন এই বাড়তি পরিতৃপ্তিবোধ? |
|
|
|
|
|