পশ্চিমবঙ্গকে ভূগোল মারিয়া রাখিয়াছে। প্রকৃতির খেয়ালে রাজ্যের অবস্থান এমনই যে এখানে হলদিয়া কেন, কোনও উৎকৃষ্ট বন্দরই সম্ভব নহে। নদীর নাব্যতা নাই, নিয়মিত পলি সঞ্চিত হইতেছে। তবু হলদিয়া হইয়াছিল। সেই বন্দর, তাহার অসম্ভাব্যতার কারণেই, জীর্ণপ্রাণ। প্রকৃতির সহিত লড়িয়া যেটুকু প্রাণশক্তি অবশিষ্ট ছিল, রাজনীতি তাহা নিংড়াইয়া লইবার ব্যবস্থা করিতেছে। এবিজি-কে লইয়া যে অশান্তি দুই মাস যাবৎ চলিতেছিল, সংস্থার কয়েক জন কর্তাব্যক্তির ‘অপহরণ’-এ তাহার যবনিকা পড়িল। এই সংস্থাটি হলদিয়া হইতে পাততাড়ি গুটাইবে, এমন আশঙ্কা এখন অতি স্পষ্ট। কিন্তু তাহাই একমাত্র ক্ষতি নহে। হলদিয়া-কাণ্ড চোখে আঙুল দিয়া দেখাইল, রাজ্য সরকার বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করিতে ব্যর্থ, বস্তুত অনিচ্ছুক। বিনিয়োগকারীরা নিরাপত্তার এই অভাব মাথায় করিয়া কোনও রাজ্যেই যাইতে চাহিবেন না, পশ্চিমবঙ্গে তো নহেই। ফলে, প্রহারেণ এবিজি-র পর এই রাজ্যটি রাজনীতিরই থাকিল। কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ সাক্ষী পশ্চিমবঙ্গবাসী ক্ষুদ্র রাজনীতির সাধনায় অলক্ষ্মী লাভ করিয়াছে। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায় যাঁহাদের ভিত্তি, একবিংশের দ্বিতীয় দশকে শুভেন্দু অধিকারী তাঁহাদের ভবিষ্যৎ।
এবিজি-র সহিত শ্রমিক সংগঠনগুলির যে বিরোধ, তাহাকে এক অর্থে আদিমতার সহিত আধুনিকতার বিরোধ হিসাবেই দেখা চলে। এই বিরোধের সহিত পশ্চিমবঙ্গ পরিচিত। এই রাজ্যেই তৎকালীন শাসকদের অনুগামীরা কম্পিউটারের প্রচলনে ঘোর আপত্তি করিয়াছিলেন, ‘শ্রমিকের ক্ষতি’র অজুহাতে। হলদিয়া বন্দরে এবিজি আধুনিক প্রযুক্তি আনিয়াছিল। তাহারা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় জাহাজ হইতে মাল খালাস করিত। যে কোনও সভ্য দেশে এই ব্যবস্থাকে সাগ্রহে স্বাগত জানানো হয়। কারণ যে কাজ কায়িক শ্রমের পরিবর্তে যন্ত্রের মাধ্যমে সম্ভব, তাহাকে যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় করাই অগ্রগতির লক্ষণ। যে কাজে কেবলই পেশিশক্তির প্রয়োজন, সেই কাজ যন্ত্র করিবে, আর মানুষের জন্য বরাদ্দ হইবে জটিলতর মেধার কাজ তাহাই আধুনিকতা। কিন্তু এই সংজ্ঞাকে মানিলে রাজনীতি হয় না। আর রাজনীতির পাশা খেলায় যে কোটি কোটি মানুষ আধুনিক শিল্পের অনুপযোগী হইয়া রহিয়াছেন, তাঁহাদের মন ভুলাইবার কাজও হয় না। ফলে বাম আমলেই হউক বা বর্তমানের তৃণমূলের জমানায়, উন্নয়নের বিরোধিতা সমানে চলিতেছে। এবিজি-কে কুলার বাতাস দিয়া বিদায় করা হইয়াছে। হলদিয়া, এবং সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ, পিছন দিকে আগাইয়া চলিতেছে। অতি দ্রুত বেগে।
তৃণমূল কংগ্রেস বারে বারে প্রমাণ করিয়াছে, তাহাদের সহিত বামপন্থীদের তফাত পতাকামাত্র। যুক্তফ্রন্টের আমলে এস ইউ সি আই-এর শ্রমমন্ত্রী সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায় যে আত্মঘাতী রাজনীতি আরম্ভ করিয়াছিলেন, পঁয়তাল্লিশ বৎসর পরেও সেই রাজনীতিই পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র। ট্রেড ইউনিয়নের নামে বিশৃঙ্খল জঙ্গিপনা একই রকম আছে। ট্রেড ইউনিয়নের নামে রাজনীতির অনুপ্রবেশও অপরিবর্তিত। কিন্তু একটি পার্থক্য হইয়াছে। সি পি আই এম-এর আমলে যে ভাবে রাজনীতি ঢুকিত, আর তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে যে ভাবে ঢুকিতেছে, তাহার ভঙ্গিতে ফারাক আছে। সি পি আই এম-এর জমানায় আর পাঁচটি দুর্নীতির ন্যায় এই ক্ষেত্রেও এক প্রকার শৃঙ্খলা ছিল। সেই শৃঙ্খলা বাম রাজনীতির অভিজ্ঞান। তৃণমূল কংগ্রেস সি পি আই এম-এর পাঠশালার সেরা পড়ুয়া বটে, কিন্তু জন্মসূত্রে কংগ্রেসি। ফলে বিশৃঙ্খলার উত্তরাধিকার তাহারা ছাড়িতে পারে নাই। হলদিয়াতেও তাহাই ঘটিয়াছে। এমন সংশয়ের কারণ আছে যে, এবিজি-কে তাড়াইতে পারিলে রাজের শাসককুলের বেশ কয়েক জন প্রতিপত্তিশালী নেতার স্বার্থরক্ষা হয় এবং সেই কারণেই শাসক দলের বিভিন্ন গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠী সেই স্বার্থের পক্ষে-বিপক্ষে কোমর বাঁধিয়া নামিয়া পড়িয়াছে। এই অভিজ্ঞতা পশ্চিমবঙ্গেও খুব সুলভ ছিল না। রাজনীতি-চালিত ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যেও যে কিছু নিয়মকানুন থাকিত, তাহাও সম্পূর্ণ বাষ্পীভূত। পড়িয়া আছে কেবল জবরদস্তির রাজনীতি। এই রাজনীতিই পশ্চিমবঙ্গের ললাটলিখন। এই রাজ্যের আর ঘুরিয়া দাঁড়াইবার জায়গা নাই। স্থলেও নাই, জলেও নাই। |