‘মেক সাম নয়েজ’।
এ শহরের গানবাজনার দুনিয়ার কাছে এটাই এখন চাহিদা এ প্রজন্মের। তুমুল শব্দ, গতি আর ঘর কাঁপানো বিটস— যা শুনতে শুনতে আপনা থেকেই স্রেফ দুলে উঠবে শরীর, তুমুল শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উদ্দাম মাথা ঝাঁকানোর সাধ জাগবে!
বিট্লস, পিঙ্ক ফ্লয়েড, রোলিং স্টোনে মজে থাকা কলকাতায় হইহই করে ঢুকে পড়েছিল বাংলা ব্যান্ড। মহীনের ঘোড়াগুলি পেরিয়ে ক্যাকটাস, পরশপাথর, চন্দ্রবিন্দু, ভূমি, লক্ষ্মীছাড়াদের গানে মাতে একটা গোটা প্রজন্ম। বছর কয়েক হল, সেই দরিয়ায় ভাটার টান। বরং ফের জাঁকিয়ে বসছে ইংরেজি রক। একটা সময়ে এ শহরের আনাচে-কানাচে ঠিক যে ভাবে গড়ে উঠেছিল পরপর বাংলা ব্যান্ড, সে ভাবেই গানপাগল ছেলেমেয়েরা গড়ে তুলছে ইংরেজি রকব্যান্ড। নতুন ইংরেজি রক ব্যান্ড খোঁজার জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতা প্রাথমিক বাছাইয়ে এসেছিল এ শহরেও। নাম লেখায় অন্তত ৪০-৪৫টি ব্যান্ড! আয়োজক সংস্থা ‘স্পার্ক’-এর তরফে এমনটাই জানাচ্ছেন সঞ্জয় সাহা।
কলকাতার প্রাথমিক বাছাই পর্বে সেই প্রতিযোগিতা, ‘সি রক’ সুযোগ দিয়েছিল ১৫টি নতুন ব্যান্ডকে। সম্প্রতি শরৎ বসু রোডের এক নিশিঠেকে যাদের গান শুনল এক দঙ্গল স্কুল-কলেজপড়ুয়া, নাচলও। আর প্রথম ও দ্বিতীয় দুই ব্যান্ডকে বেছে নিতে হিমশিম খেলেন বিচারক পল বিগলি, অঙ্কিত আদিত্যরা। দু’জনেই জানালেন জাতীয় স্তরে দুই ব্যান্ডই যে ভাল পারফর্ম করবে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। গত বছরের ‘সি রক’-এ প্রথম তিনে থাকা ‘হার্টবিটজ’ এ শহরেরই। এ বছর যারা আটটি শহরে অনুষ্ঠান করেছে। সামপ্লেস এলস, প্রিন্সটন ক্লাব-এর মতো শহরের নিশিঠেকগুলোতেও ‘হিপ পকেট’, ‘ইনসমনিয়া’ মাতাচ্ছে রাতের পর রাত। ফেসবুক, টুইটার ভরে যাচ্ছে ইংরেজি রকের আলোচনায়। |
স্বাদ বদল। বাংলা ব্যান্ড পেরিয়ে ইংরেজি রকে উদ্বেল নয়া প্রজন্ম। |
তবে কি বাংলা ব্যান্ডের রমরমা নয়, কলকাতায় ফের জাঁকিয়ে বসল ইংরেজি রক?
সেন্ট জেভিয়ার্সের খেয়া বলছেন, “বাংলা ব্যান্ডগুলো আর আমাদের মনের কথা বলে না। তা ছাড়া, ইংরেজি রক অনেক বেশি ওরিজিন্যাল।” প্রেসিডেন্সির রাহুলেরও বক্তব্য, “বাংলা ব্যান্ডের গান বহু ক্ষেত্রেই বিদেশি গানের নকল। মিউজিকের মান, উদ্দাম পারফর্ম্যান্স, বিষয় বাছাই, একটা গোটা প্রজন্মকে ধরা, ব্যান্ডের সংখ্যা বা পারফর্ম করার সুযোগ— সব ক্ষেত্রেই ইংরেজি রক অনেক এগিয়ে। আজ যদি মেটালিকা কলকাতায় পারফর্ম করে, গোটা দেশ থেকে লোকে দৌড়ে আসবে? ভাষাটাও শ্রোতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
প্রেসিডেন্সিরই বোধিরূপা বলছেন, “আমার মতো অন্য শহর বা জেলার ছেলেমেয়েদের কাছে কলকাতা মানে বাংলা ব্যান্ড।” তবে এ-ও বলছেন, “এ শহরের বন্ধুদের কাছে ইংরেজি রক ব্যান্ডগুলো অনেক বেশি প্রিয়। অত বিটের সঙ্গে নাচা যায় বেশি, কলেজ ফেস্টে তার চাহিদা তো বেশি হবেই!” যাদবপুরের শাওনের কথায়, “বাংলা ব্যান্ড অনেক বেশি আমাদের কথা বলে। যা ওয়েস্টার্ন হার্ড মেটাল রকে পাই না।”
তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী কল্লোল বা অরিত্র বলছেন, বাংলা ব্যান্ডগুলো আর নতুন কিছু দিচ্ছে না। তাঁদেরও মত, নাচানাচিতে অনেক বেশি উদ্দাম-উত্তাল হওয়া যায়— এটাই ইংরেজি রক শোনার ঝোঁক বাড়াচ্ছে। মোটের উপরে বাংলা ব্যান্ডে জনপ্রিয়তায় যে কিছুটা ভাটার টান, তা মানছেন প্রত্যেকেই।
জনপ্রিয়তা কমার কথা মানতে নারাজ বাংলা রকব্যান্ড ‘ফসিলস’-এর রূপম ইসলাম অবশ্য বলেন, “এমনটা এখনও মনে হয়নি। তবে এখনকার ছেলেমেয়েদের ইংরেজি ব্যান্ড গড়ে তোলার প্রবণতা বেশি, সেটা সত্যি। কারণ এরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ছে, লাইফস্টাইলটাও সে রকমই। তবে সম্প্রতি বাংলা ব্যান্ডের দুনিয়ায় কিছু বেনোজলও ঢুকে পড়েছে। তাতে যদি ছেলেমেয়েরা মুখ ফেরায়, তবে কিছু বলার নেই।” ‘চন্দ্রবিন্দু’র উপল বাংলা ব্যান্ড এ প্রজন্মের ভাল লাগা বা না লাগা নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি নন। তবে তিনি বলেন, “এক-এক সময়ে এক এক ধরনের গানে ঝোঁকে একটা গোটা প্রজন্ম। এক ধরনের গান হারিয়ে যায়, আবার হয়তো ফিরেও আসে। যেমন ঘটেছে পাড়ায় পাড়ায় হিন্দি গান বা ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র সঙ্গে। এটা ঠিক যে এখন আমরা কলেজে আগের মতো শো পাই না। আমাদেরও বয়স বেড়েছে, ম্যাচিওরিটিও। গানেও তার প্রতিফলন রয়েছে। কিন্তু এমনটা নয় যে, বাংলা ব্যান্ড চিরতরে হারিয়ে গেল। কলেজের দিনগুলোয় সকলেই গান নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে, এরাও করছে। সেটা ভাল হলে ক্ষতি কী!” |