এ তো নিছক নৃত্যনাট্য নয়। এ যেন জনা কুড়ি তরুণীর প্রতিবাদ। যে সমাজে তাঁদের ঠাঁই হয়নি, সেই সমাজকে দেখিয়ে দেওয়া, তাঁরাও কিছু করতে পারেন।
কিন্তু কেন তাঁদের এই প্রতিবাদ?
আসলে এক সময় এই তরুণীরা হারিয়ে গিয়েছিলেন অন্ধকার জগতে। দারিদ্রের জন্য ওঁদের কাউকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন নিজের বাবা। কাউকে বা চাকরি করে দেওয়ার টোপ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নিষিদ্ধপল্লিতে। সেই গলিঘুঁজি থেকে উদ্ধার করা হলেও নিজের বাড়িতে আর ফেরা হয়নি তাঁদের। কাউকে বা ফিরিয়ে নেয়নি পরিবার। কেউ আবার প্রবল ঘৃণায় নিজেই ফিরতে চাননি বাবার আশ্রয়ে। তাই এখন তাঁদের ঠিকানা দু’টি বেসরকারি হোম। যারা ওই অপরাধ করেছিল, তারা বহাল তবিয়তে সমাজের মূল স্রোতে থাকলেও ওই মেয়েরা আর ফিরতে পারেনি নিজের পরিমণ্ডলে। বেসরকারি হোমেই কার্যত বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন তাঁরা।
ওই মেয়েরা তাঁদের এই সব যাবতীয় ক্ষোভ-বিক্ষোভ, জ্বালা-যন্ত্রণায় উগরে দিতে চান নাচের বিভঙ্গে। তাই আগামী ২ নভেম্বর ওই তরুণীরা রবীন্দ্র সদন মঞ্চে নামবেন ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্য নিয়ে। এই নৃত্যনাট্যের আয়োজন করেছে রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা দফতর (সিআইডি)। রাজ্য পুলিশের ডিজি (সিআইডি) ভি ভি থাম্বি বলেন,“আমাদের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে উদ্ধার হওয়া মেয়েরা তাঁদের অনুষ্ঠান করবেন।” প্রতিবাদী ওই সব তরুণীর সঙ্গে ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যে অভিনয় করবেন সিআইডি-র অ্যান্টি হিউম্যান ট্রাফিকিং-এর ওসি অফিসার শর্বরী ভট্টাচার্যও। তাঁকে দেখা যাবে ‘অর্জুন’-এর ভূমিকায়। |
চলছে ‘চিত্রাঙ্গদা’র মহড়া। সুমন বল্লভের তোলা ছবি। |
আর তরুণীদের এই প্রতিবাদের প্রেরণা নাইজেল আকারা। রবীন্দ্রনাথেরই গীতিআলেখ্য ‘বাল্মিকী প্রতিভা’-র হাত ধরে জেলবন্দি নাইজেল আকারা-সহ এক দল বন্দিকে সুস্থ জীবনে ফেরার পথ দেখিয়েছিলেন নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়। ২ নভেম্বরের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে অলকানন্দা রায়েরও
হঠাৎ সমাজ পরিত্যক্ত তরুণীদের নিয়ে অনুষ্ঠান কেন?
গোয়েন্দাকর্তারা জানাচ্ছেন, ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ প্রতিষ্ঠা দিয়েছে নাইজেল আকারাকে। জেলবন্দিরা যদি পারেন, তা হলে নিরাপরাধ ওই তরুণীরা কেন সমাজের মূল স্রোতে ফিরতে পারবেন না?
এই ভাবনা থেকেই সিআইডি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অন্ধকার জগত থেকে উদ্ধার করে আনা সমাজ পরিত্যক্তদের নিয়ে ‘চিত্রাঙ্গদা’ মঞ্চস্থ করা কথা ভাবে। আর এতেই এগিয়ে আসেন ওই কুড়ি জন তরুণী। তাঁদের বার বার শোনানো হয়েছে নাইজেল আকারার ফিরে আসার কথা।
কিন্তু যাঁদের মূলস্রোতে ফেরানোর জন্য এত কিছু, সেই তরুণীরা কী বলছেন?
‘চিত্রাঙ্গদা’-র অন্যতম প্রধান শিল্পী পরভিন (নাম পরিবর্তিত) বলেন,“ইচ্ছে ছিল বড় নর্তকী
হব। কিন্তু অন্ধকার জগতে
ঠেলে দেওয়া হল। তার পর সমাজ আর ফিরিয়ে নিল না। এ বার দেখিয়ে দিতে চাই, সুযোগ পেলে আমরাও পারি।” পরভিনের ওই জেদের সুর রহিমা-হাসিনাদের গলাতেও।
রহিমা বলেন, “যাঁরা আমাদের অভিনয় দেখবেন, তাঁরা যেন আমাদের সমাজে নতুন করে প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায্য করেন।”
লড়াকু ওই সব তরুণীদের কথা শুনেছেন নাইজেল আকারাও। সোমবার তিনি বলেন,“আমাকে দেখে অনুপ্রাণিত হওয়াটা আমার কাছে বড় ব্যাপার। নিজেরা অপরাধ না করেও অন্যদের দোষে অনেক কিছুই হারিয়েছেন ওঁরা। ওঁদের বলব, পিছনের অন্ধকার দিকে ফিরে তাকাতে নেই। বর্তমানটাই আশার আলো।”
মেয়েদের আশার আলো দেখাচ্ছেন সিআইডি অফিসার শর্বরী ভট্টাচার্যও। তিনি বলেন,“সমাজ-পরিত্যক্ত এই মেয়েদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনাই আমাদের কাজ। আর তার জন্যেই এই অনুষ্ঠান।” যে বেসরকারি হোমে ওই তরুণীরা থাকেন তাদের পক্ষ থেকে এক জন বলেন,“মেয়েরা প্রাণ ঢেলে কাজ করছে। এটাই এখন তাঁদের বাঁচার লড়াই হয়ে উঠেছে।”
এই লড়াই নিয়েই এখন মশগুল কুড়িটি তরুণী। যে সমাজ বিনা দোষে ‘শাস্তি’ দিয়েছে তাঁদের, আগামী ২ নভেম্বর তার মুখোমুখি দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা। ওঁদেরই এক জন বলেন, “নিজের বাবা-ই আমাকে বিক্রি করে দিয়েছিল। আমি চাই, ওই দিন যেন তাকেও ডেকে আনা হয়। বাবাকে দেখাতে চাই, সুযোগ পেলে আমি কী করতে পারি!”
এই নৃত্যনাট্য তাই ওই তরুণীদের কাছে আলোয় ফেরার লড়াই। |