গত সপ্তাহেও তারা ছিল সরকারে সতীর্থ। এখন প্রতিপক্ষ। ‘বন্ধু’ থেকে প্রতিপক্ষে গেলে কী হয়, বৃহস্পতিবার তার সাক্ষী থাকল রাজ্য বিধানসভা! উপলক্ষ খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) বিরোধিতায় সরকারি প্রস্তাব।
পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বিধানসভার কার্যবিধির ১৬৯ ধারায় প্রস্তাব পেশ করা মাত্রই কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব আপত্তি জানালেন। বিধানসভার প্রবীণতম সদস্য, কংগ্রেস বিধায়ক জ্ঞান সিংহ সোহনপালও সোহরাবের পাশে দাঁড়িয়ে কার্যবিধির কেতাব খুলে দেখাতে চাইলেন, এই প্রস্তাব ‘বৈধ’ নয়। স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য আপত্তি মানলেন না। প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হতে সোহরাব বললেন, “ইতিহাস বড় নির্মম! পরমাণু চুক্তি নিয়ে কেন্দ্রে সমর্থন তুলে নেওয়ার পরে বামেরা সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল। এখন সংসদে এফডিআই নিয়ে প্রস্তাব এলে তৃণমূলকেও বিজেপি-র হাত ধরতে হবে!” আর যায় কোথায়? তৃণমূল শিবিরের হইচইয়ে তখন কান পাতা দায়!
এতেই শেষ নয়। তিন বছর আগের লোকসভা নির্বাচনের ইস্তাহারে এফডিআই নিয়ে তৃণমূল কী লিখেছিল (তৃণমূলের মতে, একটি জায়গায় মুদ্রণ প্রমাদ), সোহরাব তার উল্লেখ করতেই ফের হট্টগোল। দুই মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং পার্থবাবুকে দু-দু’বার উঠে পাল্টা আক্রমণে গিয়ে বলতে হল, এ ভাবে সভাকে ‘বিভ্রান্ত’ করা ঠিক নয়! দুই প্রাক্তন জোটসঙ্গীর এই বিবাদের গোটা পর্বেই নীরব দর্শক হয়ে বসে ছিলেন বাম বিধায়কেরা। এক সময় বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র ‘পয়েন্ট অফ অর্ডার’ তুলে বললেন, কার বইয়ে কী ছাপা আছে, তা-ই নিয়ে সময় নষ্ট না-করলেই নয়? ইউপিএ থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের পরে তৃণমূলের বড় শত্রু এখন কে? কংগ্রেস? গত কয়েক দিনে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে কংগ্রেসকে তোপ দাগছেন, মায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বাচনভঙ্গি পর্যন্ত প্রকাশ্যে নকল করে দেখাচ্ছেন, তাতে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ‘বিভ্রান্তি’ হওয়া স্বাভাবিক।
সেই জন্যই সম্ভবত এ দিন বিধানসভায় প্রস্তাবের উপরে বলতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ঘোষণা করতে হল, “সিপিএমকে বলছি, ভাববেন না কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের লড়াই হল বলে আপনাদের সঙ্গে ভাব করব বলে বসে আছি! আপনাদের সঙ্গে আমাদের আদর্শগত লড়াই যেমন ছিল, তেমন থাকবে। আপনাদের অত্যাচারের কথা ভুলবেন না!” মুখ্যমন্ত্রী যখন তাঁর এই ‘শত্রু’ চিহ্নিত করছেন, তখন অবশ্য বাম বিধায়কেরা সভায় ছিলেন না। তাঁদের সংশোধনী গৃহীত না-হওয়ার প্রতিবাদে তাঁরা তত ক্ষণে ওয়াকআউট করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা শুনে পরে এক বাম বিধায়কের প্রতিক্রিয়া, “আমাদের সঙ্গে উনি ভাব করবেন, এটা আবার আমরা কখন মনে করলাম? প্রস্তাবের বিরোধী ছিল কংগ্রেস। আর উনি (মমতা) আক্রমণ করলেন আমাদের! আসলে উনি ভেবেছিলেন, এফডিআই নিয়ে এই প্রস্তাবে আমরা পুরোপুরি বিরোধিতা করব। কিন্তু বাস্তবে সেটা যখন হল না এবং তৃণমূল-সিপিএম-বিজেপি একসুর বলে কংগ্রেস ওঁদের আক্রমণ করল, তখন উনি আমাদের নিশানা করে দিলেন!”
বস্তুত, সকালে আলিমুদ্দিনে বামফ্রন্টের বৈঠকে আলোচনা করে এসে এ দিন বিধানসভায় সরকারি প্রস্তাবের আগাগোড়া বিরোধিতায় যায়নি বিরোধী বামফ্রন্ট। ফরওয়ার্ড ব্লকের বিধায়ক উদয়ন গুহ যেমন পার্থবাবুর প্রস্তাব সমর্থন করেই তৃণমূলের ‘নৈতিক অধিকার’ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। উদয়নবাবুর বক্তব্য, “দ্বিতীয় ইউপিএ-র আমলে ১২ বার ডিজেলের দাম বেড়েছে। পেট্রোলের দাম বেড়েছে-কমেছে ২৩ বার। সারের দাম যখন বাড়ল, তখন তো আপনারা সরকারে। ঘুমটা একটু বেশি হয়ে গেল না পার্থবাবু?” দলনেত্রীর যুক্তিকেই হাতিয়ার করে তৃণমূল বিধায়ক রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, কালো টাকা উদ্ধার করে উন্নয়নের কাজে লাগালে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে বোঝা চাপাতে হয় না। মুখ্য সরকারি সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় কংগ্রেসের উদ্দেশে সরাসরি এই কথাও বলে দেন যে, “দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে সমাজতান্ত্রিক কথাটা কি তুলে দেওয়া হবে? আপনারা তো পুঁজিপতিদের প্রতিনিধি নন!” যার জেরে বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু মন্তব্য করেছেন, “একটা চালু কথা মনে পড়ে যাচ্ছে এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে! পুঁজিপতিদের কথা বলবেন অথচ লগ্নি পুঁজির কথা বলবেন না? এতই যখন প্রতিবাদ করছেন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নামটা বলতে কীসের আপত্তি?” প্রসঙ্গত, বামেদের সংশোধনীও ছিল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রসঙ্গ প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েই।
কে কার প্রকৃত ‘বন্ধু’ বা ‘শত্রু’ সব ‘গুলিয়ে’ যাওয়ার দিনে বাম ও কংগ্রেসের কক্ষত্যাগের পরে এফডিআই-বিরোধী প্রস্তাব গৃহীত হল। শিল্পমন্ত্রীর কথায়, “এতে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট হল। রাজ্যে যে বৃহৎ সংস্থার খুচরো বিপণি আছে, তার সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।” |