কলেজ যখন রণাঙ্গন/১
লক্ষ্য সেই ক্ষমতা দখল, সংঘর্ষের ছবিও পুরনো
শুরুটা হয় ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে। তারপর বছরভরই কলেজে কলেজে গোলমাল চলতে থাকে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন এলে সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয় বারবার। কিন্তু শিক্ষাক্ষন তো মারামারির জায়গা নয়! ছাত্ররাই বা এত অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে কেন? কেন এই পরিস্থিতি?
রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, মূল লড়াইটা ক্ষমতা দখলেরই। প্রতিটি ছাত্র সংগঠন চায় কলেজে কলেজে প্রভাব বিস্তার করতে। কিন্তু ছাত্র রাজনীতিতেই আটকে থাকে না লড়াই। প্রতিটি ছাত্র সংগঠনই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের। ফলে, কলেজ ভোট ঘিরে বৃহত্তর রাজনীতির লড়াই শুরু হয়ে যায়। বহিরাগতদের দাপট বাড়ে। তার জেরেই ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা, ছাত্র-সংঘর্ষ। আবারও জেলার কলেজ গুলিতে ভোট আসছে। সেই সূত্রেই সংঘর্ষ শুরু হয়ে গিয়েছে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে।

কার দখলে ক’টি কলেজ
বছর এসএফআই টিএমসিপি সিপি অন্যান্য
২০০৯ ১৩
২০১০ ১২
২০১১ ১৬
২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে পর্যন্ত পশ্চিম মেদিনীপুরের কলেজগুলিতে এসএফআইয়ের ‘একাধিপত্য’ ছিল। ঝাড়গ্রাম থেকে ঘাটাল, মেদিনীপুর থেকে খড়্গপুর, জেলার বিভিন্ন প্রান্তে সিপিএমের ছাত্র সংগঠনই ছিল শেষ কথা। গত বিধানসভা নির্বাচনের পরে অবশ্য ছবিটা একেবারে পাল্টে গিয়েছে। প্রভাব বেড়েছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি)। ধাক্কাটা লেগেছিল ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই। এসএফআইয়ের জেলা নেতৃত্বও তা মানছেন। তবে ক্ষমতাসীনের ‘মুখ বদল’ ছাড়া আর কিছু বিশেষ পাল্টায়নি। এক সময় এসএফআইয়ের বিরুদ্ধে মারামারি, জুলুমের যে সব অভিযোগ উঠত, এখন তা আরও বেশি করে উঠছে টিএমসিপি’র বিরুদ্ধে। গত বছর বিরোধী প্রার্থী না থাকায় জেলার বেশ কয়েকটি কলেজে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে টিএমসিপি। যে সব কলেজে ভোট হয়েছে, তার অধিকাংশতেই বিরোধীরা খুব একটা জোরদার ছিল না। ‘সন্ত্রাসের’ আবহে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও নির্বাচনে যোগ দেওয়ার প্রবণতা কমেছে। যেমন, মেদিনীপুর কলেজের কথাই ধরা যাক। আগে এই কলেজে এসএফআইয়ের ‘দাপট’ ছিল। গত বছর সেই একই ‘দাপট’ দেখিয়ে ছাত্র সংসদ দখল করে টিএমসিপি। প্রায় এক দশক পর কলেজের ছাত্র সংসদ আসে বাম-বিরোধীদের দখলে।
ছাত্র নেতাদের জবানবন্দি
প্রতিহিংসার রাজনীতি করি না। আগে বিরোধীদের মনোনয়ন দিতে দেওয়া হত না। এখন এসএফআই নির্বিঘ্নে মনোনয়ন তুলছে, জমা দিচ্ছে। বাম আমলে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়া কর্তৃপক্ষের একাংশের প্ররোচনাতেই কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটছে।
রমাপ্রসাদ গিরি, জেলা চেয়ারম্যান, টিএমসিপি।

দখলদারির রাজনীতি চলছে। জয় করার বদলে ছাত্র সংসদ দখল করা হচ্ছে। প্রতিবাদ-আন্দোলন হলে আক্রমণ হচ্ছে। কর্তৃপক্ষকে দলমতের উর্ধ্বে কাজ করতে হবে। বিশৃঙ্খলা করে পড়াশোনার পরিবেশ নষ্টের চেষ্টা হলে প্রতিবাদ হবে।
সৌগত পন্ডা, জেলা সম্পাদক, এসএফআই।

এখন টিএমসিপি যে আচরণ করছে, আগে এসএফআইও তা করত না। যারা নিজেদের ‘বড়’ সংগঠন বলে দাবি করে তাদের লক্ষ্যই হল যে ভাবেই হোক ছাত্র সংসদ দখল করা। এ জন্য বহিরাগতদের নিয়ে এসে কলেজে সন্ত্রাসও করা হয়।
মহম্মদ সইফুল, জেলা সভাপতি, সিপি।

এসএফআইয়ের কায়দায় শাসক দলের ছাত্র সংগঠন রাজনীতি করছে। পেশিশক্তি দিয়ে সন্ত্রাস করা হচ্ছে। অধ্যক্ষ-শিক্ষকদের উপর আক্রমণ হচ্ছে। কলেজে পড়াশোনার পরিবেশ বজায় রাখতে হলে কর্তৃপক্ষকেও নিরপেক্ষ হতে হবে।
ভীম মণ্ডল, জেলা সম্পাদক, ডিএসও।
কিন্তু নির্বাচনে মাত্র ১৭.৬ শতাংশ ছাত্রছাত্রী যোগ দিয়েছিলেন। সংসদের ৮৭টি আসনের মধ্যে নির্বাচন হয়েছিল ৬৪টি আসনে। মোট ২৯০৩ জন ছাত্রছাত্রীর ভোট দেওয়ার কথা ছিল। তবে ভোট পড়েছিল মাত্র ৫১১টি। একই ছবি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনেও। আগের দু’বছর এখানে নির্বাচন হয়নি। পালাবদলের আগে, ২০১১ সালের নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীই দিতে পারেনি বাম-বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলি। ১৩৩টি আসনের সবক’টিতেই এসএফআই সমর্থিতেরা জেতেন। পালাবদলের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ২০১২ সালের নির্বাচনে সংসদের আসন ছিল ১৪১ টি। এর মধ্যে ১১ টি আসনে ডান-বাম কেউই প্রার্থী দিতে পারেনি। ৬৫টি আসনে আবার ১ জন করে প্রার্থী ছিলেন। ফলে, সংশ্লিষ্ট প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। বাকি ৬৫টি আসনে নির্বাচন হয়। টিএমসিপি পায় ৪৬টি, ডিএসও ১২টি, ছাত্র পরিষদ ৩টি ও এসএফআই ৩টি আসন। সব মিলিয়ে টিএমসিপি ১০২টি আসন, ডিএসও ১২টি, এসএফআই ৮ টি ও ছাত্র পরিষদ ৭টি আসন পায়। অন্য ১টি আসন ছিল ‘টাই’।
তবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে ক্ষমতা দখল করে যে ছাত্রছাত্রীদের কাছাকাছি পৌঁছনো যায় না, তা মানছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনই। এসএফআইয়ের মধ্যেও এ নিয়ে চর্চা হয়েছে। পালাবদলের আগে পর্যন্ত যে জেলার বেশ কিছু কলেজে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার ঝোঁক ছিল, তা স্বীকার করেন সংগঠনের জেলা নেতৃত্বই। আর তাই সংগঠনের জেলা সম্মেলনের দলিলে লিখতে হয়, ‘লোকসভা নির্বাচন পরবর্তীতে জেলার কলেজগুলিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার অবকাশ না থাকায় কলেজ সংগঠনগুলিকে নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়েছে।’ লিখতে হয়, ‘নির্বাচনী ফল বিশ্লেষণে দেখা যায় যে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে উৎসাহিত হয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ জেলার বেশির ভাগ কলেজগুলিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের ঝোঁক অনেকাংশে কমে যায়। ২০০৯ ও ২০১০ সালে জেলার প্রায় সমস্ত কলেজেই ছাত্র সংসদগুলির নির্বাচন সংগঠিত হয়।’ পালাবদল হয়েছে। তবে এই ঝোঁক রয়েই গিয়েছে। সবমিলিয়ে যেন বদলেছে শুধু শাসকের ‘মুখ’ই। আর তাই ২০১০ সালের নির্বাচনে যেখানে ১২ টি কলেজের ছাত্র সংসদ ছিল এসএফআইয়ের দখলে, এক বছরের ব্যবধানে ২০১১ সালে এক ধাক্কায় তা কমে হয়েছে ২টি। অন্য দিকে, ২০১০ সালে যেখানে ৪ টি ছাত্র সংসদ ছিল টিএমসিপি’র দখলে, পালাবদলের পর তা বেড়ে হয়েছে ১৬টি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.