কার্ড সমস্যায় ফাইনালে নেই ওপারা-গুরবিন্দর
চার্চিল-কাঁটা দিয়েই চার্চিল-বধ মর্গ্যানের
ইস্টবেঙ্গল ১ (লালরিনডিকা)
চার্চিল ব্রাদার্স ০
কাঞ্চনজঙ্ঘায় ফেড কাপ সেমিফাইনাল শুরুর সাড়ে আট ঘণ্টা আগে একেবারে গোপনে হঠাৎই পুরো টিম নিয়ে স্থানীয় বর্ডার সিকিউরিটি মাঠে চলে গিয়েছিলেন ট্রেভর জেমস মর্গ্যান। শিলিগুড়ির ওই মাঠে অনুশীলন করতে গেলেই জওয়ানরা বারবার সবাইকে সতর্ক করছেন, ‘আশেপাশে বেশি দূর যাবেন না। প্রচুর কেউটে সাপ আছে।’
কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের ব্রিটিশ কোচের ঝুলিতেও একটা ‘কেউটে’ আছে কে জানত? চিডি-পেন-ওপারাদের মতো তারকাদের মধ্যে অতিরিক্ত সময়ের প্রথম মিনিটে যেটা ঝুলি থেকে বের করে ছেড়ে দিলেন মর্গ্যান। আর সেই ‘কেউটে’-র বাঁ পায়ের এক ছোবলেই চার্চিল ব্রাদার্সের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ঘায়েল। মিজোরামের লালরিনডিকার গোলেই বৃহস্পতিবার তীব্র চাপে পড়ে থাকা ইস্টবেঙ্গলের শাপমুক্তি। মেহতাবের ক্রস ব্যাক হেড করে চার্চিল বক্সে ফেলেছিলেন পেন। মাটিতে বল পড়ার মুখেই হাফ ভলিতে গোল। আর মর্গ্যান ব্রিগেডের হাতে ফাইনালের ছাড়পত্র। গড়াপেটার বদনাম, ভাল না খেলার দুর্নাম, গ্রুপ লিগে প্রচুর গোল খাওয়ায় তীব্র সমালোচনানিখুঁত স্ট্র্যাটেজিতে সব অভিযোগ থামিয়ে দেওয়ার পর আনন্দে দু’হাত তুলে লাফিয়ে উঠলেন মর্গ্যান। সাধারনত যা তিনি করেন না। টানা চার বার এই টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠল ইস্টবেঙ্গল। তার মধ্যে তিন বার ব্রিটিশ কোচের হাত ধরেই। তিনে তিন হয়ে গেল মর্গ্যানের। এ দেশে কোচিং করতে আসা কোনও বিদেশি কোচেরই যে রেকর্ড নেই। কোচের মতো ওপারা-পেন-মেহতাব-লালরিনডিকারাও যে চাপে ছিলেন তা বোঝা গেল ম্যাচের পর। ১২০ মিনিটের ধুন্ধুমার উত্তেজক ম্যাচ জেতার পরেও পুরো লাল-হলুদ বাহিনী দৌড়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করতে শুরু করল। তাদের হাতে যেন ধরা ছিল অদৃশ্য প্ল্যাকার্ড‘‘খোঁচা খাওয়া বাঘ সব সময় ভয়ঙ্কর হয়।” আরও একটা তথ্য দিতেই হচ্ছেচার্চিল কাঁটা দিয়েই চার্চিলকে বধ করলেন মর্গ্যান। কী ভাবে? ম্যাচের নায়ক লালরিনডিকা গত মরসুমে ছিলেন সুভাষ ভৌমিকের দলে!

নায়ক লালরিনডিকার সঙ্গে চিডি। উপরে বিধ্বস্ত বেটো।
শিলিগুড়ি স্টেডিয়ামের মাঠটাকে বৃহস্পতিবার রাতে মনে হচ্ছিল মস্কোর কোনও গ্যালারির দাবা বোর্ড। ৬৪ খোপে কুড়িটা ঘুঁটি নড়াচড়া করছে দুই গ্র্যান্ডমাস্টারের অঙ্গুলিহেলনে।
রিজার্ভ বেঞ্চে মাঠের দু’ দিকে বসে আছেন দুই গ্র্যান্ডমাস্টারট্রেভর জেমস মর্গ্যান আর সুভাষ ভৌমিক। দশটা করে ঘুঁটি নিয়ে। পোড়খাওয়া দুই কোচের এক-একটা চাল বদলে দিচ্ছিল ম্যাচের চেহারা। ঠিক যেমন হয়েছিল শেষ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বিশ্বনাথন আনন্দ বনাম বরিস গেঁলফার খেলায়।
চার্চিল ব্রাদার্সের ‘মন্ত্রী’ বেটোকে খেতে মর্গ্যান লাগালেন মেহতাব হোসেনকে। বাড়তি হিসাবে চোরাগোপ্তা মার। পাল্টা দিলেন সুভাষ। ইস্টবেঙ্গলের ‘মন্ত্রী’ পেন ওরজির পিছনে তিনি লাগিয়ে দিলেন বিক্রমজিৎকে। মার্কারে দু’জনেরই অবস্থা কাহিল।
নিজের ‘গজ’ ইসফাক আমেদকে কোনাকুনি ব্যবহার করলেন লাল-হলুদ কোচ। বাঁ দিক থেকে ইসফাক তাঁর সেই ভয়ঙ্কর দৌড় শুরু করতেই পাল্টা দিলেন চার্চিল কোচ। তোম্বা সিংহকে পাঠিয়ে দিলেন কাশ্মীরীকে আটকাতে।
চার্চিল স্টপার বিলালের স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট করতে ঘাড়ে তুলে দেওয়া হল চিডিকে। উল্টো দিকে হেনরিকে আটকানোর জন্য পালা করে মার্কার হলেন ওডাফা আর গুরবিন্দর।
শেষ পর্যন্ত ফেড কাপের প্রথম সেমিফাইনালটা হয়ে গেল দুই ধুরন্ধর কোচের স্ট্র্যাটেজির লড়াই। সেটা এতটাই নিখুঁত ছিল যে, এ বলে আমাকে দেখ, ও বলে আমাকে। ফলে খেলাটা কখনও দৃষ্টিনন্দন হল না। বেশির ভাগ সময় বল ঘোরাফেরা করল মাঝমাঠে। চাপে পড়ে যাওয়া দু’টো দলই চাইছিলগোল খাব না, সুযোগ পেলে গোল দেব। নকআউট ম্যাচ। ঝুঁকি নেওয়ার কোনও প্রশ্নই ছিল না। আর্দ্রতায় হাঁসফাঁস পঁচিশ হাজারের গ্যালারি। ফুটবলাররাও মাঝেমধ্যেই চলে আসছিলেন মাঠের পাশে জল খেতে। অথবা পড়ে যাচ্ছিলেন মাঝেমধ্যে।

চিডিকে আটকালেন বিলাল। ইস্টবেঙ্গল কিন্তু উতরে গেল। শিলিগুড়িতে
ফেড কাপ সেমিফাইনালে। বৃহস্পতিবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
গোয়ার ক্লাব পাঁচ-ছ’টা পাস খেলে নিজেদের খেলাটা শুরু করতেই ইস্টবেঙ্গল ধ্বংসাত্মক ফুটবল খেলে সেই চাল ভেস্তে দিল। একের পর এক ফাউল হতে শুরু করল। কার্ডের পর কার্ড। সাতটা কার্ড হল সব মিলিয়ে। গুরবিন্দর, মননদীপ, মেহতাব, ওপারা কার্ড দেখে ফেললেন। প্রত্যাঘাত করতে গিয়ে হলুদ কার্ড দেখলেন চার্চিলের থাঞ্জাম, তোম্বা সিংহ, লেনি। অতি সতর্কতার ম্যাচে গোলের সুযোগ যে আসেনি তা নয়। পেনের কাছ থেকে বল পেয়ে চিডি গোলের সুযোগ পেয়েও সন্দীপ নন্দীর হাতে বল তুলে দিলেন। চার্চিলের হেনরিও সুযোগ নষ্ট করলেন। আক্রমও বদলি নেমে চার্চিলকে এগিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে সেটপিসে দু’দলেরই দেখা গেল চূড়ান্ত দৈন্যদশা। ‘ভারতের বেকহ্যাম’ বেটো ছ’টা ফ্রি-কিক পেয়েছিলেন। একটাও কাজে লাগাতে পারেননি। কর্নারেও সুভাষের টিম পাস করতে পারেননি। ইস্টবেঙ্গলের মেহতাব, পেনদেরও একই হাল।
লিখতে দ্বিধা নেই, গ্রুপ লিগের তিনটে ম্যাচ দেখার পর চার্চিল ব্রাদার্সকে মনে হচ্ছিল, অমর। কারও হাতেই যেন তাদের ‘মৃত্যু’ নেই। আর ইস্টবেঙ্গল? যেন ভগ্নপ্রায় রাজপ্রাসাদ। মনে হয়েছিল সেমিফাইনালটা এক তরফা হবে। এটা ঘটনা, যে কেউই ম্যাচটা জিততে পারত। কিন্তু মর্গ্যান কৃতিত্ব পাবেন অন্য কারণে। ৬০-৪০ পিছিয়ে থাকা ম্যাচ নিখুঁত অঙ্কে ৫০-৫০ করে ফেলার জন্য। চার্চিলের প্রধান অস্ত্র ছিল গতি আর নাগাড়ে পাস খেলে বিপক্ষের বক্সে হানা দেওয়া। মর্গ্যান খেলার গতি কমিয়ে শুরু থেকেই সেটা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। উইং প্লে বলে কিছু ছিল না দু’দলেরই। ছেঁড়া ছেঁড়া যা আক্রমণ ১১০ মিনিটে গোলের আগে পর্যন্ত হল, তা উঠে আসছিল ডাউন দ্য মিডল দিয়ে। বেটো-হেনরিরা বল ধরলেই ঘিরে ধরছিলেন সৌমিক-খাবরা-মেহতাব। গোলের এক মিনিট পরেই লালকার্ড দেখে বেরিয়ে যেতে হল চার্চিলের ইজরায়েলকে।

খেলার পরে বেটো
কলকাতা থেকে কয়েক হাজার দর্শক এসেছিলেন খেলা দেখতে। স্টেডিয়ামের আশেপাশের হোটেলগুলোতে ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই অবস্থা। তাঁরা বিশাল বিশাল পতাকা নিয়ে এসেছিলেন বটে, কিন্তু মুখ শুকনো করে, আশঙ্কা বুকে নিয়ে। অনেকেরই কলকাতায় ফেরার টিকিটও কাটা ছিল। কিন্তু সামনের তিনটি দিন তাঁদের থেকে যেতেই হচ্ছে। রবিবার ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের প্রতিপক্ষ কে হবে, ডেম্পো না সালগাওকর, তা জানা যাবে আজ। যে-ই হোক, দলের দুই স্টপার ওপারা-গুরবিন্দরকে পাবেন না মর্গ্যান। দু’জনেই কার্ড-সমস্যায়। ইস্টবেঙ্গল কোচ এ সব নিয়ে ম্যাচের পর মাথা ঘামাতে চাননি। বলে দিলেন, “আমাকে আজকের জয়টা উপভোগ করতে দিন।”

ইস্টবেঙ্গল: অভিজিৎ, নওবা, ওপারা, গুরবিন্দর, সৌমিক, খাবরা (লালরিনডিকা), মেহতাব, পেন, ইসফাক (সঞ্জু), মননদীপ (বলজিৎ), চিডি।
চার্চিল ব্রাদার্স: সন্দীপ, ডেঞ্জিল, রাভানন, বিলাল, থাঞ্জাম, তোম্বা, লেনি, বিক্রমজিৎ, বিনীশ (ইজরায়েল), বেটো, হেনরি (আক্রম)।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.