প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণের ভার সরকারের বলেই জানিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট। সব ক্ষেত্রে নিলামের মাধ্যমে সম্পদ বণ্টন করার প্রয়োজন নেই বলেও জানিয়েছে শীর্ষ আদালত। টুজি মামলার রায় নিয়ে ‘প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্স’-এর জবাবে এই অভিমত জানিয়েছে প্রধান বিচারপতি এস এইচ কপাডিয়ার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ। স্পেকট্রাম, কয়লাখনির মতো প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টন নিয়ে একের পর এক ধাক্কায় জেরবার ইউপিএ সরকার সুপ্রিম কোর্টের এই মতে স্বস্তি পেল।
ফেব্রুয়ারিতে টুজি স্পেকট্রাম সংক্রান্ত ১২২টি লাইসেন্স বাতিল করে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। প্রাক্তন টেলিকমমন্ত্রী এ রাজা নিয়ম ভেঙে স্পেকট্রাম বণ্টন করেছেন বলে রায় দিয়েছিল বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায় ও বিচারপতি জি এস সিঙ্ঘভির বেঞ্চ। সব প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে নিলাম করা উচিত বলেও মন্তব্য করেছিল বেঞ্চ। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলে কেন্দ্র এবং বণিকসভাগুলি। সব ক্ষেত্রে নিলাম অসম্ভব বলে মন্তব্য করেন টেলিকমমন্ত্রী ও আইনজীবী কপিল সিব্বল।
রায় পুনর্বিবেচনার আর্জির পাশাপাশি ‘প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্স’ পদ্ধতির মাধ্যমে এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। এই পদ্ধতিতে শীর্ষ আদালতের কাছে রায়ের ব্যাখ্যা চাওয়ার অধিকার আছে রাষ্ট্রপতির।
টুজি মামলার রায় পুনর্বিবেচনার সম্ভাবনা খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। স্পেকট্রামের ক্ষেত্রে নিলামের পথেই হাঁটতে হবে কেন্দ্রকে। তবে সব প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষেত্রেই নিলাম করা উচিত কি না সেই প্রশ্ন বিবেচনা করতে রাজি হয় পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ। আজ সেই প্রশ্নেরই জবাব দিয়েছে আদালত।
বেঞ্চের বক্তব্য, টুজি মামলার রায় কেবল স্পেকট্রামের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। সব ক্ষেত্রেই নিলাম করতে হবে এমন কোনও বিধান সংবিধানে নেই। কোন ক্ষেত্রে কী পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে তা সরকারই ঠিক করবে।
টুজি স্পেকট্রাম নিলাম না করায় কেন্দ্রের ১,৭২,০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছিল কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)। বেঞ্চের মতে, সব ক্ষেত্রে আয় বাড়ানোটা একমাত্র লক্ষ্য নাও হতে পারে। সম্পদ বণ্টনের সময়ে প্রথমে মাথায় রাখতে হবে জনস্বার্থের কথা। যদি একতরফা ভাবে আর্থিক নীতি নির্ধারণ করা হয় তবে সেই নীতি খারিজ করে দেওয়ার অধিকার আদালতের আছে।
সুপ্রিম কোর্টের এই মতে সরকারের অবস্থানই বৈধতা পেয়েছে বলে দাবি কপিল সিব্বলের। তাঁর বক্তব্য, নিলাম সম্পদ বণ্টনের একমাত্র উপায় হতে পারে না বলে আগেই জানিয়েছিল কেন্দ্র। সুপ্রিম কোর্টও আজ সে কথাই বলেছে। কয়লাখনি বণ্টনের ক্ষেত্রেও নিলাম না করায় সরকারের বিপুল আর্থিক ক্ষতির কথা সম্প্রতি জানিয়েছে সিএজি। বার বার আর্থিক ক্ষতির প্রশ্নে অস্বস্তিতে পড়েছে কেন্দ্র।
আজ সিএজিকে কটাক্ষ করেছেন সিব্বল। তাঁর মতে, টুজি মামলার রায় সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে হয়তো ধরে নিয়েছিল সিএজি-র মতো প্রতিষ্ঠানগুলি। বিষয়টি নিয়ে সাংবিধানিক জটিলতা এ দিন কাটিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
কংগ্রেস ও সরকারের বক্তব্য, স্পেকট্রাম বণ্টনের ক্ষেত্রে কেন নিলাম না করে আগে এলে আগে পাবে নীতি নেওয়া হয়েছিল তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল সিএজি। একই প্রশ্ন তোলা হয়েছে কয়লাখনি বণ্টনের ক্ষেত্রেও। সুপ্রিম কোর্টের এই মতে স্পষ্ট যে, এই প্রশ্ন তোলার এক্তিয়ারই সিএজি-র নেই। কংগ্রেস মুখপাত্র মণীশ তিওয়ারির কথায়, “জিরো লাগিয়ে সিএজি হিরো হচ্ছিল। কিন্তু আদতে যে কোনও ক্ষতিই হয়নি তা স্পষ্ট হয়ে গেল।” মণীশের বক্তব্য, স্পেকট্রাম নিলাম করলে টেলিফোনের ‘কল রেট’ বেড়ে যেত। তাতে অসুবিধায় পড়তেন উপভোক্তারাই। বরং আগে এলে আগে পাবে নীতির জন্য বাজারে অনেক প্রতিযোগী এসেছে। তাতে উপভোক্তারা লাভবান হয়েছেন। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের ধারণা, সিএজি রিপোর্ট নিয়ে বিজেপি প্রচার চালালে কংগ্রেস আদালতের রায় নিয়ে পাল্টা প্রচার চালাবে। বিজেপি নেতা ও আইনজীবী অরুণ জেটলির বক্তব্য, নীতি নির্ধারণ যে সরকারের এক্তিয়ার তা তাঁরাও প্রথম থেকেই বলে আসছেন। কিন্তু, কোনও ক্ষেত্রেই দুর্নীতি বরদাস্ত করা যায় না। তাঁর কথায়, “এখন সরকারের যা অবস্থা তাতে আমি নিজে নিলামেরই পক্ষে।” তাঁর দাবি, স্পেকট্রাম ও কয়লাখনি বণ্টন যে একতরফা ভাবে হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে বণিকসভাগুলিও। প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে কেবল নিলামের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে সরব হয়েছিল তারাও। ফিকি-র ভাইস প্রেসিডেন্ট সিদ্ধার্থ বিড়লার বক্তব্য, প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে নীতির অস্পষ্টতায় অনেক প্রকল্প আটকে রয়েছে। এখন হয়তো এই বিষয়ে নীতি নির্ধারণ সহজ হবে। সিআইআই-র প্রেসিডেন্ট আদি গোদরেজের কথায়, “সব পরিস্থিতি বিচার করলে এটাই যুক্তিসঙ্গত সমাধান।” |