তৃণমূলের বাধা আর নেই। ভর্তুকিতে রাশ টানতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকও রেলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণে পরিষেবা কর-ছাড় আর বহাল রাখতে নারাজ। ফলে অক্টোবর থেকেই সমস্ত বাতানুকূল শ্রেণিতে এবং পণ্য পরিবহণে ৩.৭ শতাংশ বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে। যাঁরা আগাম টিকিট কেটেছেন, তাঁরাও ছাড় পাবেন না। যাত্রার সময়ে টিকিট পরীক্ষক বাড়তি ভাড়া আদায় করবেন।
রেলে পণ্য পরিবহণে পরিষেবা কর বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২০০৯-১০ সালের বাজেটে। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় সেই ঘোষণা করার পরেই আপত্তি জানান তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে কর আদায় স্থগিত থাকে। বাতানুকূল শ্রেণিতে কর বসানোর সিদ্ধান্ত হয় শেষ বাজেটে। ফের তৃণমূলের আপত্তি। ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কর আদায়ে স্থগিতাদেশ দেয় অর্থ মন্ত্রক।
ইউপিএ থেকে মমতা বিদায় নেওয়ার পরে সেই ছাড়ের সীমা আর বাড়াতে চাননি বর্তমান অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। গত কাল ভারপ্রাপ্ত রেলমন্ত্রী সি পি জোশীর সঙ্গে বৈঠকে সে কথা জানিয়ে দেন তিনি। রেলের কোষাগারের এমনিতেই হাঁড়ির হাল। তার উপর ডিজেলের দাম বাড়ায় ১২৫০ কোটি টাকার বাড়তি দায় চেপেছে। ফলে পরিষেবা করের অর্থ নিজের পকেট থেকে দেওয়ার ক্ষমতা রেলের নেই। তাই সরাসরি তা আদায় করার সিদ্ধান্ত হয়। এমনিতে পরিষেবা করের হার ১২.৩৬ শতাংশ হলেও যাত্রী ভাড়া ও পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ ছাড় দেওয়ায় তা ৩.৭ শতাংশে দাঁড়াবে। তবে কেটারিং বা স্টেশনে গাড়ি রাখার মতো পরিষেবার জন্য পুরো কর দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত জানার পরে ফেসবুকে মমতার তির্যক মন্তব্য: আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি... অবশ্যই ভোটে, নোটে নয়... গণতন্ত্র ও আম-আদমির স্বার্থে দেশের সেবা করুন।
ক’দিন আগেই ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, তার পরে আজ রেলে পণ্য পরিবহণে পরিষেবা কর চালুর সিদ্ধান্ত সব মিলিয়ে জিনিসপত্রের দাম আরও এক প্রস্ত বাড়ার আশঙ্কা। কেন্দ্রের অবশ্য যুক্তি, ভর্তুকির বিপুল বোঝা আখেরে সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হচ্ছে। সরাসরি দাম বাড়ালে সমাজের নিম্নবিত্ত অংশের উপর তুলনায় কম চাপ পড়বে। যেমন, বাতানুকূল শ্রেণিতে পরিষেবা কর উচ্চবিত্তরাই দেবেন। আর পণ্য পরিবহণে খরচ এত সামান্য বাড়বে যে, নতুন করে মূল্যবৃদ্ধির ভয় কম।
এই যুক্তির পরেও আশঙ্কা যে নেই তা নয়। ইউপিএ-র শরিক দলগুলি, এমনকী কংগ্রেসেরও একটা অংশ মনে করছে, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ানোর রাজনৈতিক ফল ভুগতে হবে। আজ সনিয়া গাঁধীর নেতৃত্বে ইউপিএ-র সমন্বয় কমিটির বৈঠকে তাই ডিএমকে, এনসিপি নেতারা বলেন, আর্থিক সংস্কার করে নির্বাচনে জেতা যায় না। শরদ পওয়ার, টি আর বালুরা দাবি তুলেছেন, ডিজেলের দাম কিছুটা কমানো হোক। ভর্তুকি মূল্যে দেওয়া সিলিন্ডারের সংখ্যাও বাড়ানো হোক। ঘরোয়া আলোচনায় দুই সমর্থক দল বহুজন সমাজ পার্টি এবং সমাজবাদী পার্টিও পরিষেবা কর চালুর সমালোচনা করেছে।
সরকারি সূত্রের বক্তব্য, শরিক এবং কংগ্রেসের একাংশের এই আশঙ্কার কথা মাথায় রেখেই এক্ষুনি সব শ্রেণিতে রেল ভাড়া বাড়ানোর পথে হাঁটা হচ্ছে না। প্রয়োজনে রেল বাজেটের সময় ভাড়া বাড়ানো হবে। তখন বলা হবে, পরিষেবা বাড়ানোর জন্যই ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে।
তবে সরকার যে সংস্কারের রাস্তা থেকে সরছে না, তা আজ ফের স্পষ্ট করেছেন মনমোহন-চিদম্বরম। ডিজেল-রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি ছাঁটাই নিয়ে সিদ্ধান্তে অনড় থেকেছেন তাঁরা। বরং টাকার দাম স্থিতিশীল করা এবং বিনিয়োগ টানার জন্য সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথাই বৈঠকে তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারি সূত্রের খবর, খুচরো ব্যবসার পর এ বার বিমা ক্ষেত্রেও বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ২৬% থেকে বাড়িয়ে ৪৯%-এ নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে অর্থ মন্ত্রক।
বৈঠক শেষে চিদম্বরমের দাবি, সব শরিক সরকারের পাশে রয়েছে। তিনি বলেন, “নির্দিষ্ট কোনও সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা হয়নি। এ নিয়ে মন্ত্রিসভায় কথা হবে। তবে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা হয়েছে। সকলেই একমত যে সংস্কারের ফলে মানুষের উপর বোঝা চাপবে, কিন্তু এ ছাড়া উপায়ও নেই।” |