এ যেন টি-২০ ম্যাচ।
বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির জন্য দরজা খুলে দেওয়া থেকে শুরু। সেই ধাক্কায় তৃণমূল সঙ্গ ছাড়লেও পিছু হটেননি মনমোহন সিংহ। পরের পর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভর্তুকির বোঝা কমিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রক্রিয়ায় গতি আনতে। তাতে নতুন সংযোজন জমি অধিগ্রহণ। বৃহস্পতিবার মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠকে জমি অধিগ্রহণে সরকারের ভূমিকা অনেকটাই বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। যার ফলে নতুন আইনেও যাতে দেশে শিল্পের জন্য জমি পেতে সমস্যায় না পড়তে হয়, সে দিকে নজর রাখা হয়েছে। পাশাপাশি উৎপাদন-শিল্পতালুকের জন্য জমি অধিগ্রহণকে জনস্বার্থের আওতায় এনে প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিলেন, দেশের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের উপর জোর দিতে চাইছেন তিনি। এই সিদ্ধান্তের ফলে উৎপাদনমুখী শিল্প বাড়ার সম্ভাবনা তো থাকছেই, সঙ্গে থাকছে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সম্ভাবনাও।
অন্য বহু সংস্কারের মতো জমি অধিগ্রহণ বিলও এত দিন মূলত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে আটকে ছিল। জমি আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা মমতার বক্তব্য, বেসরকারি শিল্পের জন্য শিল্পসংস্থাকেই পুরো জমি বাজার থেকে কিনে নিতে হবে। এই চাপ সত্ত্বেও গত বছর সংসদে নতুন যে বিলটি পেশ করে কেন্দ্র, সেখানে বলা হয়, সরকার ইচ্ছে করলে সর্বোচ্চ ২০% জমি শিল্পকে অধিগ্রহণ করে দিতে পারবে। তবে মমতাকে খুশি করতে সংশ্লিষ্ট রাজ্যকে এই নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও দেওয়া হয়েছিল বিলে।
কিন্তু মমতা জোট ছেড়ে বেরোতেই শিল্পায়নের স্বার্থে সরকারের সেই এক্তিয়ার এক লাফে প্রায় ১৩ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর প্রস্তাব মতো এ দিন ঠিক হয়, বেসরকারি শিল্পের জন্য সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতা থাকবে সরকারের হাতে। তা ছাড়াও উৎপাদন-শিল্পতালুক এবং লজিস্টিক পার্ক গড়ে তোলার জন্য সরকার আপৎকালীন ভিত্তিতে জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে। জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণের সংজ্ঞায় এ বার এই বিষয়গুলিও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ ও আইনমন্ত্রী সলমন খুরশিদের বক্তব্য, কেন্দ্রের এই প্রস্তাব পশ্চিমবঙ্গ না-ও মানতে পারে। ঠিক যে ভাবে বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশে আপত্তি করছে রাজ্য। কিন্তু তৃণমূল নেতারা বুঝতে পারছেন যে, এর ফলে শিল্পমহলে পশ্চিমবঙ্গের ভাবমূর্তি যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা-ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পড়শি রাজ্যগুলি যদি শিল্পের জন্য অধিগ্রহণে হস্তক্ষেপ করে, তা হলে বৈষম্যের পরিবেশ তৈরি হবে। পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করতে কেউই উৎসাহী হবেন না। তাই মনমোহনের এই প্রস্তাবে তৃণমূল যে সংসদে আপত্তি করবে, তা নিয়ে সংশয় নেই।
কিন্তু সরকারের শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, তৃণমূলের সম্ভাব্য সেই বিরোধিতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ চিন্তিত নন। বরং তাঁর উদ্বেগ ছিল, সংসদে যে জমি বিলটি পেশ করা হয়েছে, তা শিল্পায়ন ও পরিকাঠামো উন্নয়নের সহায়ক নয়। শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রী আনন্দ শর্মাও এই নিয়ে তাঁর কাছে অনেক দিন ধরে দরবার করছিলেন। তাই বিলটি ফের মন্ত্রিগোষ্ঠীর বিবেচনার জন্য পাঠান প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সচিবালয়ের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পুলক চট্টোপাধ্যায় বৈঠক করেন জয়রামের সঙ্গে। জয়রামকে জানিয়ে দেওয়া হয়, বিলটিকে আরও শিল্পবন্ধু করে তুলতে হবে। তাই শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে যেমন সরকারের ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে, তেমনই অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া আরও সরল করারও পক্ষে প্রধানমন্ত্রী। সরকারি সূত্রে খবর, অধিগ্রহণে সরকারের এক্তিয়ার এক-তৃতীয়াংশ করা নিয়ে মন্ত্রিগোষ্ঠীতে সর্বসম্মতি হয়ে গিয়েছে। বৈঠক শেষে জয়রাম বলেছেন, “নতুন বিলটি অনেক বেশি শিল্পবন্ধু হবে।” প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের এক কর্তার কথায়, পরিবর্তিত জমি বিল শিল্পমহলে ইতিবাচক বার্তা পাঠাবে বলেই আশা করা হচ্ছে।
তবে সরকার শুধু শিল্পমহলের স্বার্থ দেখছে, জমি বিল নিয়ে এমন সমালোচনার মুখে পড়তে রাজি নন সনিয়া-রাহুল। তাই বৈঠকে ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও ওঠে। নগরোন্নয়ন মন্ত্রী কমল নাথ বৈঠকের পরে বলেন, বর্তমান বিলে বলা হয়েছে, সার্কেল রেট-কে (ভূমি রাজস্ব দফতর থেকে এলাকায় বেঁধে দেওয়া দাম) জমির বাজার মূল্য হিসেবে ধরা হবে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে এই দাম বাস্তব বাজার মূল্যের কম থাকে। তাই চাষিরা যাতে বঞ্চিত না হন, সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। একটা প্রস্তাব হল, সংশ্লিষ্ট গ্রামসভা জমির উৎপাদনশীলতা বিচার করে বাজার মূল্য ঠিক করবে।
আগামী সপ্তাহে মন্ত্রিগোষ্ঠীর পরবর্তী বৈঠকে জমি বিলটি চূড়ান্ত করে ফেলা যাবে বলেই মনে করা হচ্ছে। তার পর মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে বিলটি পেশ করবে সরকার। তার পরে বিলের ভবিষ্যৎ কী? খাতায়কলমে সংসদে সংখ্যালঘু সরকারের চিন্তা থেকেই গেল।
|
মনমোহনী দাওয়াই |
• শিল্পের জন্য অধিগ্রহণে সরকারের ক্ষমতা ২০% থেকে বেড়ে এক-তৃতীয়াংশ (৩৩%)
• উৎপাদন-শিল্পতালুক ও লজিস্টিক পার্ক এ বার জনস্বার্থের আওতায়
• চাষিদের অনুমতি ছাড়াই এই ক্ষেত্রে পুরো অধিগ্রহণের অধিকার রাজ্যের
• এ ক্ষেত্রে প্রথম কিস্তির ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু করা যাবে কাজ
• ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে চাষিদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে ব্যবস্থা নেওয়ার ভাবনা
• অধিগ্রহণে সরকারের কতটা ভূমিকা থাকবে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য |
|