যুবকল্যাণমন্ত্রীর ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছেন পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী। বুক চিতিয়ে লড়ছেন শিল্পমন্ত্রী। দুদ্দাড় করে উঠে আসছেন পরিবহণমন্ত্রীও। মন্ত্রী বা বিধায়ক নন, তবু কলকাতার মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য)-এর দৌড়ই বা কীসে কম!
পুজো-আপডেটের সার-সংক্ষেপে এটুকু না লিখলেই নয়। এমন নয় যে নেতা-মন্ত্রীর দাপট ছাড়া পুজোই হচ্ছে না কলকাতায়। এমনও নয়, এই প্রথম কলকাতার পুজোয় রাজনৈতিক নেতাদের ছায়া পড়ল। কিন্তু নেতা-মন্ত্রী-রাজ্যসভার সাংসদ-কাউন্সিলর থেকে ব্লক সভাপতি, সবাইকে এমন ঢাকঢোল পিটিয়ে পুজোর ময়দানে নামতে আগে কি দেখেছে কলকাতা?
বাম জমানায় শাসক দলের নেতাদের মধ্যে সরাসরি পুজো করা নিয়ে কিন্তু-কিন্তু ছিল। কিন্তু মাথার উপরে রাজনৈতিক ‘দাদা’দের হাত থাকলে পুলিশ-দমকলের ছাড়পত্রের ক্ষেত্রে তখনও ‘সুবিধে’ হত। পুজো কমিটির সুভেনিরে জনপ্রতিনিধিদের নামও দেখা যেত আকছার। তবে তা ছিল প্রধানত আলঙ্কারিক উপস্থিতি। এ বার ‘উপদেষ্টা’ বা ‘প্রধান পৃষ্ঠপোষক’-এর নামমাত্র অস্তিত্ব থেকে এক লাফে কমিটির ‘সভাপতি’-র ভূমিকায় উঠে এসেছেন বেশ কয়েক জন বিধায়ক বা মন্ত্রী।
তাতে কী? নতুন ‘পুজো-কর্তা’রা ক’জন এই রাজসূয় যজ্ঞের খুঁটিনাটি বোঝেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কলকাতার পুজোর পুরনো ‘দাদা’ লেবুতলা পার্কের প্রদীপ ঘোষ। আমহার্স্ট স্ট্রিটে কালীপুজো-খ্যাত সোমেন মিত্র বা একডালিয়ার কাপ্তেন সুব্রত মুখোপাধ্যায় আরও পুরনো। তাঁরাও পুজোর জুতোসেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের খেয়াল রাখেন। সিপিএমের ভিতরে বিতর্ক থাকলেও জনসংযোগের হাতিয়ার হিসেবে পুজোকে ব্যবহারে অনড় ছিলেন তখন তরুণ তুর্কি নেতা সুজিত বসু। অধুনা তৃণমূল বিধায়ক সুজিতের তখনকার ‘গডফাদার’ সুভাষ চক্রবর্তীও তাঁকে খোলা মনে মদত জোগাতেন।
পুজোর গভীরে ঢুকুন কিংবা না-ঢুকুন এ কালের ‘দাদা’দের নাম-মাহাত্ম্য অন্য রকম। ভবানীপুর, কালীঘাট, বরাহনগর, কামারহাটি থেকে হুগলির কম করে ৪০টি পুজোর ব্যানারে মদন মিত্রের নাম। চেতলায় চোদ্দ আনা পুজোর সভাপতির নামই ববি (ফিরহাদ) হাকিম। মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের নাম ব্যবহার করতেও বেহালার পুজো কমিটিগুলির উৎসাহের অন্ত নেই। মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও বহু পুজোর ‘উপদেষ্টা’। শোভন ছাড়া বাকিদের সকলেরই কিন্তু কোনও একটি নির্দিষ্ট পুজোর প্রতি বিশেষ ‘দুর্বলতা’। নেতাদের প্রতিপত্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই পুজোর জৌলুসও বাড়ছে চড়চড়িয়ে।
ববি মন্ত্রী হওয়ার আগে চেতলায় তাঁর নিজের পুজোর খোঁজ করতেন না পুজো-বোদ্ধারা। এ বার তারা শহরের অন্যতম বিগ-বাজেট পুজো। নাকতলায় পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘পাড়ার পুজো’ও গত বারই স্পনসরের কৃপাধন্য গেটের সংখ্যায় নজর কাড়ে। পুজোর নামী শিল্পীরাও তখন থেকেই তাদের মুঠোয়। পার্থ অবশ্য তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকার সঙ্গে পুজোর গরিমাবৃদ্ধির সম্পর্ক মানবেন না। ওই তল্লাটে বিশিষ্টজনের অভাব নেই বলেই বোঝাচ্ছেন তিনি। তাঁর কথায়, “আমার নেতা হওয়াটাই বরং ডিসঅ্যাডভান্টেজ। আগে বড় চাকরি করার সময়ে যত সহজে চাইতে পারতাম, এখন পারি না!”
মদন কিন্তু পুজোর ‘বদল’টিকে সহজ ভাবে বোঝাচ্ছেন, “আগে পুজোর সভাপতি হিসেবে বড় ব্যবসায়ীদের নাম থাকত। এখন নেতারা আছি। নেতারা থাকলে সব জায়গাতেই কুইক অ্যাকসেস (মসৃণ যোগাযোগ) হয়।” ববি বলছেন, “আমি তো সকলকেই বলছি, দেখ ভাই বিজ্ঞাপন দিতে পারব না। তবু সকলেরই আমার নামটার জন্য টানাটানি।”
সে-কাল, এ-কালের ‘পুজোর দাদা’দের ফারাকটা মালুম হবে পুরকর্তা অতীন ঘোষকে দেখলেও। অদ্ভূত দক্ষতায় হাতিবাগানে ও সিকদারবাগানের তিনটি পুজোর প্রতি ‘দায়বদ্ধতা’ রক্ষা করে চলেছেন। তাঁর কথায়, “আমার পরিচিতি কাজে লাগিয়ে যখন যা সাহায্য পাচ্ছি, তিন জনের মধ্যেই ভাগ করে দিচ্ছি।” পোড়খাওয়া মন্ত্রী সুব্রত এমন ‘বহুগামিতা’র ঘোর বিরোধী। একটি পোশাক ব্র্যান্ডের পুরনো বিজ্ঞাপন উদ্ধৃত করে বলছেন, “আমি হচ্ছি ওনলি একডালিয়া। অন্য কোনও পুজোকে আমার নামটাও ব্যবহার করতে দেব না।” অতীন নিজেই বলছেন, “আমার তিনটে পুজোর কিন্তু ভয়ও আছে। ফাঁস হওয়ার আতঙ্কে থিমের দু-একটা গোপন কথা আমাকেও বলছে না।” পুরনো দাদাদের ক্ষেত্রে যা অভাবনীয়। এ যুগের দাদাদের মধ্যে ব্যতিক্রম অরূপ বিশ্বাস। সুরুচির পুজোয় সব কিছুতে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন তিনি। ‘দাদা’দের নিয়ে অবশ্য খুচখাচ অসন্তোষও রয়েছে। দক্ষিণ কলকাতার একটি পুজোয় এক মন্ত্রী নাকি জোর করে সভাপতি হয়েছেন। গত বারের কমিটির অনেকেই এ বছর তাই পুজোর কাজে নেই। বেহালার একটি পুজোও খানিকটা নিমরাজি হয়েই সভাপতি হিসেবে স্থানীয় কাউন্সিলরকে মেনে নিচ্ছে।
পুজোর ময়দানে দাদায়-দাদায় রেষারেষির আবহে ‘দিদি’ কিন্তু সবাইকে মিলিয়ে দিচ্ছেন। পুজো কমিটিগুলির সঙ্গে বৈঠকে ‘সব পুজোই আমার পুজো’ বলে ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। |