আগের দিন আবেদন করেছিলেন। বুধবার ‘কড়া হুঁশিয়ারি’ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়ে দিলেন, জোর করে কেউ ধর্মঘট করতে চাইলে সরকার তা হতে দেবে না। সরকারি কর্মীদের কাজে উপস্থিত থাকতে বলে ধর্মঘটের আগের দিন শেষ বেলায় সরকারি নির্দেশও জারি হল। কিন্তু বৃহস্পতিবারের সাধারণ ধর্মঘট মোকাবিলায় সরকারি তরফে আগের মতো সেই ‘সাজো সাজো’ রব অনুপস্থিত। যার ফলে ঈষৎ ‘বিভ্রান্ত’ সরকারি কর্মচারী মহল।
আবার সাধারণ ধর্মঘটের ঠিক আগের দিন পরিবহণমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পরে বেসরকারি বাস-মালিকদের সংগঠন বাস ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আজ, বৃহস্পতি বারের ধর্মঘট স্থগিত রেখেছে খুচরো ব্যবসায়ীদের সংগঠনও। পরিবহণে ধর্মঘট থাকলে সাধারণ ভাবে বন্ধের পালেও
হাওয়া লাগত। মুখে স্বীকার না-করলেও এই ঘটনাপ্রবাহে ঈষৎ চিন্তায় ধর্মঘটকারীরাও।
এখন প্রশ্ন, আজ আর একটি কর্মনাশা সাধারণ ধর্মঘটে কী করবেন রাজ্যবাসী? কারণ, সরকার আশ্বাস দিচ্ছে, বেশি সংখ্যায় সরকারি বাস রাস্তায় থাকবে। বিরোধী বামফ্রন্ট শিবির ‘আশ্বস্ত’ করছে, জোর করে কেউ ধর্মঘট করতে কাউকে ‘বাধ্য’ করবে না। এই পরিস্থিতিতে সপ্তাহের মাঝে একটি ‘ছুটির দিনে’র হাতছানি ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গ রাস্তায় বেরোবে কি না, পরীক্ষা তারই।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার মহাকরণে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “বন্ধের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। বিরোধীরা এখনও বন্ধের রাজনীতি করে যাচ্ছে। বন্ধ হলে সব মিলিয়ে প্রায় দু’হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়।” মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, অনেক আগেই তাঁর দল বন্ধের রাজনীতি থেকে সরে এসেছে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “বন্ধ ডাকা হলেও সরকার দোকান, বাজার, বাস, ট্রাম চালু রাখবে।” পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রও এ দিন দাবি করেছেন, ধর্মঘট রুখতে রাস্তায় অনেক বেশি সংখ্যায় সরকারি বাস চালানো হবে।
সরকারের এই অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “ধর্মঘট শ্রমজীবী মানুষের শেষ হাতিয়ার। যে দাবি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতে গিয়েছেন, সেই দাবিতেই এই ধর্মঘট। মুখ্যমন্ত্রীকে আমরা বলছি, এই বিষয়ে উনি যে হেতু কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতে গিয়েছেন, তাই এই ধর্মঘটের বিরোধিতায় যাবেন না। তাঁর উচিত, ধর্মঘট সমর্থন করা।”
বস্তুত, সরকারি মহলের একাংশেরও ধারণা, এ বারের ধর্মঘটের বিষয় যে হেতু ডিজেল ও রান্নার গ্যাস মহার্ঘ হওয়া এবং খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) প্রতিবাদ, তাই তার বিরোধিতায় আগের মতো ‘দৃঢ়’ হতে কোথাও যেন বাধছে তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের। রাজ্য সরকারের এই ‘দ্বিধাগ্রস্ততা’র খানিকটা প্রতিফলনই যেন ধরা পড়েছে এ দিন একেবারে শেষ মুহূর্তে ধর্মঘটে কর্মীদের উপস্থিত থাকার জন্য নির্দেশ জারির ঘটনায়। প্রশাসনের একাধিক কর্তার মতে, ধর্মঘটের আগের দিন শেষ মুহূর্তে কর্মীদের উপস্থিতির নোটিস জারি করলে তা সারা রাজ্যে ঠিক সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া সমস্যা। বিশেষত, শিক্ষা দফতরের পক্ষে তাদের সব বিভাগে এই নোটিস কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাঠানো প্রায় অসম্ভব। এই সরকারের জমানায় আগের ধর্মঘটগুলিতে আগেভাগেই এমন নির্দেশিকা জারি হয়ে গিয়েছিল। এমনকী, কর্মীদের উপস্থিতির হার বাড়াতে সরকারের তরফে ‘ব্রেক অফ সার্ভিস’ বা কর্মজীবনে ছেদ পড়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছিল। ধর্মঘটের দিন কর্মীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আগের দিন মহাকরণ ও অন্য সরকারি দফতরে রাত্রিবাসের অনুমতিও দিয়েছিলেন মুখ্যসচিব। যে ছবি এ বার অমিল।
তৃণমূল-প্রভাবিত রাজ্য সরকারি কর্মচারী সংগঠনগুলির তরফে অবশ্য দাবি করা হয়েছে, রাতে না-জাগলেও এ বার কর্মচারীদের উপস্থিতি থাকবে ‘চোখে পড়া’র মতো। এমনই এক সংগঠনের নেতার কথায়, “অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, প্রশাসন সচল থাকে। তাই রাতে জাগার আর দরকার নেই। বাস-মিনিবাসও ধর্মঘট তুলে নিয়েছে। তাই সব কর্মীই ঠিক সময়ে দফতরে উপস্থিত হবেন।”
ধর্মঘটের দিন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কলকাতা পুলিশের মোট কুড়ি হাজার কর্মীকে রাস্তায় নামানো হচ্ছে। কলকাতা পুলিশ সূত্রের খবর, বন্ধের দিন রাস্তায় থাকছে ৬০টি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড ও ২৫টি হেভি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড। এ ছাড়াও বিশেষ নজরদারি থাকবে বাস ডিপো ও স্টেশন, ট্রামডিপো, বাজার ও ৫২টি দফতর সংলগ্ন এলাকায়। শহর জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় থাকবে পুলিশ পিকেটিং। যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম বলেন, “অনেক সময় দেখা যায়, বন্ধ শুরু হওয়ার আগেই অর্থাৎ ভোরেই হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে যায়। তাই এ বার ভোরবেলা থেকেই রাস্তায় বিশেষ করে বাসস্ট্যান্ড, স্টেশনগুলিতে পুলিশ মোতায়েন করা হবে।”
প্রশাসনের মনোভাবে তাঁরা কি অশান্তির আশঙ্কা করছেন? সূর্যবাবুর বক্তব্য, “আমরা আবেদন করছি, জোর করে কেউ যেন দোকান-বাজার বন্ধ না করে। আবার জোর করে যেন ধর্মঘট ভাঙাও না হয়। তেমন চেষ্টা হলে অশান্তির দায় সরকারের।” নিরুপম সেন এ দিনই দুর্গাপুরে আশাপ্রকাশ করেছেন, “মুদ্রাস্ফীতি, পরিবহণের খরচের বোঝা বাড়ায় হাসফাঁস করছেন সাধারণ মানুষ। কাজেই ধর্মঘট সফল হবে।”
শহরের অনেক নামী স্কুল অবশ্য ‘ঝুঁকি’ নিচ্ছে না। যেমন, লা মার্টিনিয়ার, মহাদেবী বিড়লা, এপিজে, মডার্ন হাই স্কুল, রামমোহন মিশন, সেন্ট্রাল মডার্ন স্কুল এ রকম অনেক ইংরেজি মাধ্যম স্কুল জানিয়ে দিয়েছে আজ, বৃহস্পতিবার ক্লাস হবে না। তার বদলে কোথাও কোথাও শনিবার ক্লাস হবে বলে জানানো হয়েছে। ‘ফোরাম অফ ট্রেডার্স অর্গানাইজেশন অফ ওয়েস্টবেঙ্গল’-এর তরফে রবীন্দ্রনাথ কোলে জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আজ ধর্মঘট করার কথা ছিল তাঁদের। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ওই সিদ্ধান্তেরই প্রতিবাদ করে ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করায় তাঁরাও ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন। |