মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘না’ বলিয়াছেন। প্রধানমন্ত্রীর সংস্কারবাসনা তাঁহার পছন্দ হয় নাই। তাঁহার রাজনীতিতে সংস্কারের ঠাঁই নাই, কলিকাতার বর্তমান গণপরিবহণশূন্য রাজপথ সাক্ষ্য দিবে। তিনি কংগ্রেসকে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য সময় বাঁধিয়া দিয়াছিলেন। সেই সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর তিনি ঘোষণা করিলেন, এই সরকারে আর থাকিবেন না। রাজনীতির মাপকাঠিতে শুক্রবার দুপুর আসিতে এখনও অনেক দেরি। শেষ পর্যন্ত তৃণমূল কংগ্রেসের মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র জমা পড়িবে কি না, সেই জল্পনা অবান্তর। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বদলান নাই, তাহা সংশয়াতীত। তিনি আদিতে বঙ্গজ বামপন্থী বিরোধী নেত্রী। দেখা যাইতেছে, অন্তেও তাহাই। বঙ্গজ বামপন্থীরা, ক্ষমতার যে পার্শ্বেই থাকুন না কেন, চরিত্রগত ভাবে বিরোধী। নেতিই তাঁহাদের মন্ত্র। শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় ব্যতিক্রম নহেন। তিনি ‘না’-ই বলেন। সংস্কারেচ্ছা প্রকাশ করিয়া মনমোহন সিংহ কোনও অপ্রত্যাশিত বা অ-পূর্ব প্রতিক্রিয়া পান নাই।
তাঁহার প্রতিটি ‘না’-ই যে ভ্রান্ত, তাহা নহে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পালানিয়াপ্পান চিদম্বরমের ন্যাশনাল কাউন্টারটেররিজম সেন্টার-এর প্রস্তাবে তিনি যখন না করিয়াছিলেন, অথবা তাঁহাকে এড়াইয়া তৈরি করা তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি মানিতে তিনি যখন অস্বীকার করিয়াছিলেন, তখন সেই নেতি যথার্থ ছিল। অন্য দিকে, তিনি যখন কৃষক এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দোহাই পাড়িয়া খুচরা বিপণনে বিদেশি পুঁজির বিরোধিতা করেন অথবা পেট্রোলিয়ামের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব সর্বান্তকরণে রুখিতে চাহেন, তখন বোঝা যায়, অর্থনীতির যুক্তির সহিত তাঁহার শত যোজন দূরত্ব। কিন্তু তাঁহার অবস্থান ঠিক হউক বা ভুল, দৌড় ওই নেতি পর্যন্তই। তিনি কী চাহেন না, তাহাতে তিনি সংশয়ের অবকাশ রাখেন না। কিন্তু কী চাহেন, সেই প্রশ্নে কুয়াশা অগাধ। তাঁহার পূর্বসূরি বামপন্থীরা অন্তত একটি অলীক স্বপ্নের পশ্চাদ্ধাবন করিতেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কৃতিত্ব, তিনি কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার কষ্টকল্পনা ত্যাগ করিয়া শিল্পায়নের একটি পথ নির্দেশ করিয়াছিলেন। সেই পথ সকলের পছন্দ না হইতে পারে, কিন্তু এ কথা কেহ অস্বীকার করিবেন না যে, তাঁহার একটি গন্তব্য ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোথায় পৌঁছাইতে চাহেন, তাহা এখনও অজ্ঞাত।
অথচ, নেতি হইতে ইতি-তে উত্তরণের বহু সুযোগ তিনি নিজেই তৈরি করিয়াছেন। ন্যাশনাল কাউন্টারটেররিজম সেন্টার-এর বিরোধিতার সময়, অথবা কেন্দ্রের নিকট রাজ্যের জন্য অধিকতর অর্থ দাবি করিবার সময় তিনি সচ্ছন্দে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রকৃত প্রয়োগের দাবি করিতে পারিতেন। সংবিধানে আটকাইলে সংবিধান সংশোধনের দাবিই পেশ করিতে পারিতেন। কেন্দ্র ছাড়িয়া রাজ্যের দিকে তাকাইলেও সেই একই সুযোগের অপচয়। তিনি কোনও মতেই বাসভাড়া বাড়াইবেন না, তাহা বহুঘোষিত। কিন্তু, পরিবহণ নীতি কোথায়? তিনি বলিতেই পারিতেন, গণপরিবহণে জোর দেওয়া হইবে। প্রচুর সরকারি বাস চলিবে, বেসরকারি বাস আরও বেশি। ভাড়া না বাড়ানোয় যত ঘাটতি হইবে, সেই টাকা তিনি রাজকোষ হইতে জোগাইবেন। নীতিটি নিঃসন্দেহে আত্মঘাতী হইত, কিন্তু অন্তত একটি নীতি হইত, নিছক নেতি নহে। আবার, খুচরা বিপণনে বিদেশি পুঁজির (আরও কঠোর অবস্থানে যে কোনও বৃহৎ পুঁজির) বিরোধিতাকে একটি প্রকৃষ্ট ইতিবাচক পরিণতিতে লইয়া যাওয়া সম্ভব ছিল। তাঁহার অধীনে সমবায় মন্ত্রক আছে, কিন্তু সেই মন্ত্রকের কাজ নাই। কৃষি সমবায় গঠনের মাধ্যমে তিনি একটি বিকল্প কৃষিনীতি তৈরি করিতে পারিতেন। ভার্গিস কুরিয়ন বহু পূর্বেই প্রমাণ করিয়াছেন, কৃষি সমবায় শুধুমাত্র আদর্শের ফাঁকা বুলি নহে, তাহা অতি বাণিজ্যসফল একটি বিকল্প হইতে পারে। মোট কথা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও নেতির চৌকাঠ পার হইয়া ইতি-র আঙিনায় পা ফেলিতে পারেন নাই। তিনি যখন নিছক বিরোধী নেত্রী ছিলেন, তখনও শুধু নেতিতে এক রকম কাজ চলিত। এখন তিনি শাসক। এখনও বিরোধীর পোশাক পরিলে তাঁহাকে মানাইবে কেন? |