|
|
|
|
নিজস্ব মেজাজেই ‘ধাক্কা’ দিলেন কংগ্রেসকে |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
গোড়ায় ঠিক ছিল সরকার ছাড়বেন, কিন্তু জোট ছাড়বেন না। “একটা লক্ষ্মণরেখা রাখতে হবে”, নিজেই বলেছিলেন তৃণমূল নেত্রী।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী এমন হল যে ইউপিএ-র সঙ্গে সম্পর্কে ইতি টানলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
আসল কারণ জানেন খোদ মমতাই। তবে তৃণমূল সূত্র বলছে, এর প্রথম কারণ হল, মমতা মনে করছেন শুধু সরকার ছাড়লে কেন্দ্রকে যথেষ্ট ধাক্কা দেওয়া যাবে না। তার বদলে সমর্থন প্রত্যাহারের ‘শক থেরাপি’ দিলে কংগ্রেস নতুন করে আলোচনায় আসতে বাধ্য হবে। কারণ, মুলায়ম-মায়াবতীর ভরসায় সরকার চালানোটা বেশ ঝুঁকির হয়ে যাবে। আর দ্বিতীয় কারণ, মমতার রাজনীতির নিজস্ব ‘স্টাইল’। মুলায়ম বা মায়াবতীর মতো নেতারা অনেক সময়েই দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক লাভের অঙ্ক কষে সিদ্ধান্ত নেন। সে জন্য স্বল্পমেয়াদি ভাবমূর্তির লোকসান স্বীকার করে নেন তাঁরা। কিন্তু মমতার রাজনীতি হল, ভাল নৈশভোজের আশায় প্রাতরাশকে অবজ্ঞা করা চলবে না।
মূলত এই দু’টি কারণেই প্রথমে মন্ত্রীদের প্রত্যাহার করার কথা ভেবেও মমতা পরে পুরোপুরি বিচ্ছেদ ঘোষণা করলেন বলে মনে করা হচ্ছে। সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হবে জেনেই এই স্নায়ুর যুদ্ধকে শুক্রবার পর্যন্ত জিইয়ে রাখার কৌশল নিয়েছেন তিনি। সেই কারণেই রাষ্ট্রপতির কাছে সমর্থন প্রত্যাহারের চিঠি এখনও পাঠাননি তৃণমূল নেত্রী। শুক্রবার বিকেল তিনটের আগে মুকুল রায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়রা ইস্তফাও দিচ্ছেন না। সব মিলিয়ে সংস্কার নিয়ে কংগ্রেস যে অনড় মনোভাব নিয়েছে, তাতে একটা চিড় ধরিয়ে দেওয়ার রণকৌশল নিয়েছেন মমতা। |
|
মহাকরণে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার রাজীব বসুর তোলা ছবি। |
তবে ওই স্নায়ুযুদ্ধে কংগ্রেস পলক ফেলবে, এমন কোনও ইঙ্গিত বুধবার রাত পর্যন্ত নেই। বরং দলীয় সূত্রে যা ইঙ্গিত, তাতে মমতাকে ছাড়াই সরকার চালানোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। ডিএমকে-র মতো শরিক বা সমাজবাদী পার্টির মতো সহযোগী দল সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আন্দোলনে নামলেও শেষ পর্যন্ত পাশে থাকবে বলেই কংগ্রেসের বিশ্বাস। তিনি সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলেও সরকার যে পড়বে না সেটা মমতাও জানতেন। সেই কারণেই গোড়ায় তেমন পদক্ষেপের কথা তিনি বলেননি। প্রথম ইউপিএ সরকারের সঙ্গে প্রকাশ কারাট যা করেছিলেন, দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের সঙ্গে তা করতে চাননি মমতা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি মত বদলেছেন।
রাজনীতির কারবারিদের অনেকেরই মতে, জনমানসে তাঁর আচরণ কী ভাবমূর্তি সৃষ্টি করছে, সংবাদমাধ্যমে তা কী ভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে, মমতার কাছে এ সবের গুরুত্ব অনেক। গত কালই এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন,“তৃণমূল যদি শুধু মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসত, তা হলে সংবাদমাধ্যমই প্রচার করত আমি হাফ হার্টেডলি কাজ করেছি।” তা ছাড়া, ৭২ ঘণ্টার সময়সীমা ঘোষণা করার পর থেকেই সিপিএম এবং প্রদেশ কংগ্রেস বলতে শুরু করেছিল, মমতা আসলে নাটক করেছেন। ইউপিএ ছেড়ে তারও জবাব দেওয়া গেল বলে মনে করছে তৃণমূল।
তৃণমূল নেতাদের আরও দাবি, এই পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে বাংলা বন্ধের আগে সিপিএম-কে বেশ কিছুটা ঘায়েল করে দিতে পেরেছেন মমতা। পশ্চিমবঙ্গে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেস নয় সিপিএম। বস্তুত সিপিএমের থেকেও বেশি বামপন্থী হয়ে মহাকরণ দখল করেছেন তৃণমূল নেত্রী। আর এখন বাঙালির কেন্দ্র-বিরোধী বাম রোম্যান্টিক মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে সেই দখলদারিকে পোক্ত করতে চাইছেন।
অন্য দিকে, ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে জাতীয় স্তরে কংগ্রেস-বিরোধী রাজনীতির অন্যতম নায়িকা হয়ে উঠতে চাইছেন মমতা। তাঁর নিজের বিশ্লেষণ দুর্নীতি ও মূল্যবৃদ্ধির জন্য দ্রুত জনসমর্থন হারাচ্ছে কংগ্রেস। আঞ্চলিক দলগুলির নেতাদের অনেকেরই লক্ষ্য এই পরিসর দখল করা। মমতা তাঁদের থেকে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকতে চাইছেন। গত কাল তিনি এ-ও বলেছেন যে, কেন সমর্থন প্রত্যাহার করলেন তা বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে মানুষকে বোঝাবেন।
মমতা অনেক দিন ধরেই কেন্দ্রে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ভাবছিলেন। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বেশ কিছু দিন থেকেই বলছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কেন্দ্রের সঙ্গে সহজ স্বাভাবিক সাংবিধানিক সম্পর্ক রক্ষা করা যায়। তার জন্য ইউপিএ বা এনডিএ কোনও জোটে সামিল হওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়। এই মুহূর্তে ওড়িশার নবীন পট্টনায়ক বা তামিলনাড়ুর জয়ললিতা কোনও জোটের শরিক নন।
সমর্থন প্রত্যাহার করার পরে কেন্দ্রের সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে চান না মমতা। বরং আর্থিক বা মাওবাদী সমস্যা মোকাবিলার প্রশ্নে কেন্দ্রের সহযোগিতার দাবি তিনি জানাবেন আগের মতোই।
কিন্তু এই একলা চলার লড়াইয়ে যে ঝুঁকি আছে, সেটা মমতার জানা। তিনি সেই ঝুঁকি নিয়েছেন। |
|
|
|
|
|