বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটা ভালই কেটেছিল বাসকর্মীদের। বছর ঘুরে এমন একটা দিনে কার্যত পড়ে পাওয়া ‘ছুটি’, সৌজন্যে সোমবার থেকে শুরু হওয়া বাস ধর্মঘট। চার দিনের মাথায় আজ, বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টার বন্ধে সেই কর্মহীনতাই কার্যত চুড়ো ছুঁতে চলেছে। ষোলকলা পূর্ণ হতে চলেছে আমজনতার ভোগান্তির।
রাজনীতি বনাম অর্থনীতির দড়ি টানাটানিতে কী হাল হয়েছে পথ চলতে চাওয়া মানুষের, মঙ্গলবার পেরিয়ে বুধবারও তা চোখে পড়েছে।
বাম-বিজেপি বন্ধ ডেকেছে বৃহস্পতিবার থেকে। কিন্তু তার আগের দিন, বুধবারেই অনেকটা যেন বন্ধের চেহারা নিয়েছিল বর্ধমান শহর। প্রতি দিনই অন্তত লক্ষাধিক মানুষ নানা কাজে জেলাসদরে আসেন। বাস না চলায় তাঁধের সিংহ ভাগই আসতে পারেননি। স্বাভাবিক ভাবেই, দোকানপাট ফাঁকা। বাজারে টাটকা তরিতরকারির জোগান কার্যত নেই। মাছের বাজারেও এলাকার ছোট বা মাঝারি সাইজের মাছের টান। |
একই অবস্থা কাটোয়া-কালনাতেও। শুধু আশপাশের গ্রাম নয়, রুজি-রোজগারের জন্য পাশের নদিয়া, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম থেকে রোজ কয়েক হাজার মানুষ কাটোয়ায় যাতায়াত করেন। তাঁদের একটা বড় অংশ আসতে পারেননি। ফলে ব্যবসার ক্ষতি তো আছেই, কর্মচারীরা আসতে না পারায় দোকানদারেরা ঠিক মতো পরিষেবাও দিতে পারছেন না। বন্ধে এই ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। ব্যবসায়ী সমিতির আক্ষেপ, কার্যত গোটা সপ্তাহটাই কাজকর্ম গোল্লায় গেল।
বর্ধমান শহরের তিনকোনিয়ার ব্যবসায়ী অসীম কর্মকারের কথায়, “ধর্মঘটের জেরে মাত্র তিন দিনেই আমাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। সামনে পুজো। তার উপরে বন্ধ মানে আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীদের পেটে হাত পড়া।’’ আর এক ব্যবসায়ী মধুসূদন দাসের কথায়, “বর্ধমান শহরের ব্যবসা বেশির ভাগটাই গ্রামনির্ভর। গ্রামের মানুষ না এলে আমাদের কিছু করার থাকে না।” কলকাতায় যাঁরা চাকরি বা ব্যবসা করতে যান, তাঁরাও পড়েছেন আতান্তরে। অম্বিকা কালনা, বাঘনাপাড়া, ধাত্রীগ্রাম, নান্দাই, পূর্বস্থলী, পাটুলির এ রকম অনেকেই ট্রেন ধরতে যেতে পারেননি।
সরকারি বাস কিছু চোখে পড়েছে ঠিকই। কিন্তু কালনা থেকে মেমারি বা বিটরা যাওয়ার মতো বেশ কিছু রুটে সরকারি বাস চলে না। ফলে যে মোটরভ্যান নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা-ই যাত্রীদের সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে। |
ট্রাক, ম্যাটাডর, ট্রেকার হাতের কাছে যা পেয়েছেন তাতেই চড়ে বসেছেন যাত্রীরা। বাড়ি ফেরার সময়েও দীর্ঘক্ষণ হাপিত্যেশ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে নিত্যযাত্রীদের। মওকা বুঝে চার গুণ দর হেঁকেছেন ভ্যান বা ট্রেকার চালকদের অনেকে। রায়নার উচালন থেকে সরমা বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছিলেন বর্ধমানের খোসবাগানে ডাক্তার দেখাতে। যাতায়াত বাবদ লেগেছে ৭৫ টাকা। তাঁর কথায়, “বেশি দিন এ সব চললে ভাল ডাক্তার না দেখিয়েই মরতে হবে।”
ভিড় উপচে পড়েছে ট্রেনেও। ভাতার থেকে বর্ধমানে বিবেকানন্দ কলেজে আসেন রবিশঙ্কর দাস। বাস না চলায় ট্রেন ধরছেন। কিন্তু ট্রেনের সময় কলেজের সঙ্গে মেলে না। বাড়ি ফিরতে প্রচুর দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাঁর অভিযোগ, “বাড়ি গিয়ে লেখাপড়ার সময় আর পাচ্ছি না।” ধানবাদ থেকে ট্রেনে কাটোয়ায় আসা অসিত দত্ত বলেন, “অন্য সময় হলে বর্ধমানে নেমে বাস ধরতাম। বাস বন্ধ থাকায় ব্যান্ডেল হয়ে ঘুরে কাটোয়া আসতে হল।” কার্যত ‘ঠাঁই নাই’ অবস্থা নৌকাতেও। বীরভূমের নানুরের বাসিন্দা হুমায়ুন শেখের কথায়, “কৃষ্ণনগর যেতে হবে। সহজেই কাটোয়া থেকে নবদ্বীপ হয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু বাস বন্ধ থাকায় কাটোয়া থেকে ভাগীরথী পেরিয়ে, দেবগ্রাম হয়ে যেতে হচ্ছে।” ফেরিঘাটের ইজারাদারদের আশঙ্কা, ভিড়ের ঠেলায় দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে।
তিন দিন দুর্ভোগের পরে এ দিন বিকেলে অবশ্য জেলা বাস সমিতির সম্পাদক তুষার ঘোষ বলেন, “রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনার পরে বাস সিন্ডিকেট ১০ দিনের জন্য ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছে।” কিন্তু ধর্মঘট উঠল তো এ বার বন্ধ! ফলে অন্তত কাল, শুক্রবারের আগে সব রুটে বেসরকারি বাস চলার আশাই নেই।
ধর্মঘট-বন্ধের দিনগুলিতে বিশ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে বর্ধমান শহরে আসেন কুড়মুনের বাসব কোঙার। ফেরার সময়ে ফের অতটা রাস্তা প্যাডেল ঘোরানো। তাঁর কথায়, “কাজটা তো টেকাতে হবে। কিন্তু কত দিন আর এমন করে ৪০ কিলোমিটার করে সাইকেল ঠেলব!”
রাজনীতি বড় বালাই! আজ আবার নৌকা, ভ্যান, ট্রেকার চলাও ‘মানা’। রাজনীতির এই পথে শেষে সাইকেল (বা মোটরসাইকেল) ছাড়া কিছুর দেখা মিলবে কি? |