এক ধাক্কায় বিতর্কের বিষয়টাই বদলে গিয়েছে। গত সপ্তাহের মাঝামাঝি সময় পর্যন্তও জাতীয় রাজনীতির প্রধান আলোচ্য ছিল কয়লা দুর্নীতি। সেখান থেকে আর্থিক সংস্কারে বিতর্কটাকে টেনে নিয়ে এসেছে কংগ্রেস। যে বিতর্কে সওয়াল করতে নেমে কয়লা কেলেঙ্কারির তুলনায় অনেকটাই স্বস্তি বোধ করছেন দলের নেতারা।
কয়লা খনি বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করেই সংসদের বাদল অধিবেশন ধুয়ে গিয়েছে। এই কয়লা-অস্ত্র হাতে নিয়েই লোকসভা নির্বাচনের লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু হঠাৎ করেই সংস্কারের পথে মনমোহন সরকারের একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত সকলের সব হিসেব এলোমেলো করে দিয়েছে। বদলাচ্ছে রাজনৈতিক সমীকরণও। বিজেপি-কেও নতুন করে ঘুঁটি সাজাতে হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদীর মতো অনেকেই খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের পক্ষে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভোট-ব্যাঙ্কের কথা ভেবে বিজেপি-কে এখন খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের বিরোধিতা করতে হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বিজেপি এখন বাম ও অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলিকেও কংগ্রেস-বিরোধী রাজনীতির ছাতায় আনতে চাইছে। সেই অনুযায়ী সব দলের সঙ্গে আলোচনা করেই বিজেপি ২০ সেপ্টেম্বর ভারত বন্ধের ডাক দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কংগ্রেসের উপর চাপ বাড়াতে ইউপিএ-র শরিক তৃণমূল, এনসিপি-র মতো দলগুলিকে সমর্থন প্রত্যাহারের আহ্বান জানাচ্ছেন বিজেপি ও এনডিএ নেতারা।
গত কালই প্রধানমন্ত্রী ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছেন। সেই সুরে মনমোহন সরকারের মন্ত্রী তথা কংগ্রেসের নেতারা আজ সারা দিন ধরেই সংস্কারের পক্ষে সওয়াল চালিয়ে গিয়েছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকেও সংস্কারের পক্ষে পাঁচ দফা যুক্তি দেওয়া হয়েছে। দু’দশক আগে মনমোহন সিংহের শুরু করা আর্থিক সংস্কারের ফলে এ দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় কী কী ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কর্তারা তা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, ব্যাঙ্ক পরিষেবা থেকে শুরু করে পাকা বাড়ি, বিদ্যুৎ বা টেলিফোন থেকে শুরু করে রান্নার গ্যাস এক দশকে সাধারণ মানুষই আর্থিক সংস্কারের লাভবান হয়েছেন। ৭ কোটি ৭০ লক্ষ পরিবার ব্যাঙ্ক পরিষেবা পেয়েছেন। ৩ কোটি ৪০ লক্ষ পরিবারের মাথার উপর পাকা ছাদ এসেছে। ৬ কোটি বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। ১৩ কোটি ৭০ লক্ষ বাড়িতে টেলিফোন পৌঁছেছে। রান্নার গ্যাস পৌঁছেছে ৩ কোটি ৭০ লক্ষ বাড়িতে।
কংগ্রেসের নেতারা সংস্কারের ভাল-মন্দের গণ্ডির মধ্যেই বিতর্কটা সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছেন। তাঁরা চান, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নিতে কৃষকদের লাভ বেশি না দোকানদারদের ক্ষতি বেশি, তা নিয়ে যুক্তির লড়াই হোক। এই বিতর্কেই খনি বণ্টন নিয়ে বিতর্ক ধামাচাপা পড়ে যাবে।
কংগ্রেসের এই আশার কথাই প্রকাশ্যে বলে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার শিন্দে। পুণেতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “এই সব বিতর্ক আসতে যেতে থাকে। আগে বোফর্স নিয়ে বিতর্ক ছিল। পরে তা মিলিয়ে গিয়েছে। পেট্রোল পাম্প বণ্টন নিয়ে বিতর্কের কথাও কেউ মনে রাখেনি।” এই বিতর্কের জন্য শিন্দেকে বিজেপি, বাম ও অন্যান্য বিরোধী নেতাদের আক্রমণের মুখেও পড়তে হয়েছিল। বিজেপি নেতা বলবীর পুঞ্জ মনে করিয়ে দিয়েছেন, “বোফর্স দুর্নীতির পরেই কংগ্রেসকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল। মানুষ ভুলে গিয়েছে কি না, সেটা অন্য কথা। কিন্তু কংগ্রেস ভুলে গিয়েছে যে বোফর্সের পরে কংগ্রেস আর কখনও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।” সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট কটাক্ষ করেছেন, “২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন এলেই বোঝা যাবে মানুষ কী মনে রেখেছেন আর কী মনে রাখেননি।” কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে বিতর্ক জিইয়ে রাখতে চাইলেও বিজেপি-কে কিন্তু এখন আর্থিক সংস্কার ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির মতো বিষয়েই ঘুঁটি সাজাতে হচ্ছে। বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর যুক্তি, “প্রণব মুখোপাধ্যায় সংসদে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য না হওয়া পর্যন্ত সরকার এ বিষয়ে অনুমোদন দেবে না। সরকার কিন্তু সংসদে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখল না।”
শরিকদের সঙ্গে আলোচনা না করে বা ঐকমত্য ছাড়াই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আজ মমতার কাছেও সমর্থন প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন বিজেপি নেতারা। একই ভাবে শিবসেনার তরফেও এনসিপি-কে সমর্থন প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক সমীকরণও তাই বদলাচ্ছে। সম্প্রতি কয়লা কেলেঙ্কারিতে কংগ্রেস ও বিজেপি-কে দুষছিলেন প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরিরা। দু’পক্ষই দুর্নীতিগ্রস্ত বলে দু’দলের নেতারাই সংসদে বিতর্ক এড়াতে চাইছেন বলে তাঁরা অভিযোগ তোলেন। এখন কিন্তু আবার বিজেপি এবং বাম নেতারা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় রেখে চলছেন। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেই একই দিনে বিজেপি ভারত বন্ধের ডাক দিয়েছে এবং বামেরা দেশ জুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও ত্রিপুরায় বামেরা ১২ ঘণ্টার ধর্মঘটেরও ডাক দিয়েছেন। |