অনেক দিন পর সূর্য উঠেছে শেয়ার বাজারে। ভিজে চুপসে যাওয়া কাকপক্ষীর মতো বহু শেয়ার ডানা ঝাপটে আবার ওড়ার চেষ্টা করছে। নতুন করে কলরব শোনা যাচ্ছে বাজারের আনাচে-কানাচে।
সোনা বা রুপো নয়, শুক্রবার ছিল শেয়ারের দিন। হঠাৎই বাজারের পালে জোরালো হাওয়া লাগে সরকার সংস্কারের পথে নামায়। ডিজেল এবং গ্যাসের দাম বাড়ায় আমজনতা যতটা ক্ষোভে ফেটে পড়েছে, প্রায় ততটাই খুশি হয়েছে আমলগ্নিকারী। এতে তেল সংস্থাগুলির জন্য ভর্তুকি কমবে। শুধু তা-ই নয়, পথ প্রশস্ত হয়েছে খুচরো ব্যবসায় সরাসরি বিদেশি লগ্নির। খুচরো ব্যবসায় ৫১ শতাংশ ছাড়াও ৪৯ শতাংশ বিদেশি লগ্নি অনুমোদিত হয়েছে বিমান পরিবহণ এবং বিদ্যুৎ ব্যবসায়। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয়েছে, চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণের ব্যাপারেও।
এত দিন ঝিমিয়ে থাকা মনমোহন সরকার একলপ্তে এতগুলি সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ভাল শেয়ার তো বটেই, বাজারের বেতো ঘোড়াগুলিও দৌড়তে শুরু করে। এই উত্থানে মদত জুগিয়েছে বিশ্বের বড় বাজারগুলিও। মার্কিন শীর্ষ ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজার্ভ সে-দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে তৃতীয় দফায় উৎসাহ প্যাকেজ ঘোষণা করায় তেতে ওঠে মার্কিন তথা ইউরোপীয় বাজারগুলি। এই তপ্ত ঢেউ এসে পৌঁছয় ভারতীয় তটেও। দেশি ও বিদেশি শক্তি একযোগে মাঠে নামায় শুক্রবার সেনসেক্স তরতরিয়ে ওঠে ৪৪৩ পয়েন্ট। চলতি বছরে এটিই সর্বোচ্চ উত্থান। সূচক পৌঁছয় ১৮,৪৬৪ অঙ্কে, যা গত ১৪ মাসে সর্বোচ্চ।
বাজারের এই উত্থান টনিকের কাজ করেছে ইক্যুইটি-নির্ভর মিউচুয়াল ফান্ডগুলির ক্ষেত্রে। গত সপ্তাহে ন্যাভ্ ফুলে-ফেঁপে উঠেছে বেশির ভাগ ইক্যুইটি প্রকল্পের।
ভারত তথা বিশ্ব বাজারের কাছে শুক্রবার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। পরের কাজের দিন, অর্থাৎ আজ সোমবারও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় ভারতীয় শিল্প-বাণিজ্য মহল এবং শেয়ার বাজারের কাছে। বিশ্বকর্মার কাছে আজ শিল্পমহলের প্রার্থনা থাকবে, সুব্বারাও যেন সুদ এবং সিআরআর কমান। শুক্রবার স্টেট ব্যাঙ্ক-সহ বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্কের বড় রকমের উত্থান হয়েছে এই আশায়।
তবে ডিজেলের দাম বাড়ায় মূল্যবৃদ্ধি যে আবার লাগামছাড়া হয়ে উঠতে পারে, সে কথা ঋণনীতি পর্যালোচনার সময়ে অবশ্যই মাথায় রাখবেন দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্কের কর্ণধার ডি সুব্বারাও। অর্থাৎ সম্ভাবনা বেশি নগদ জমার অনুপাত বা সিআরআর হ্রাস পাওয়ার। স্টেট ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান সিআরআর ব্যবস্থার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। সিআরআর কমলে বাজারের টাকার জোগান বাড়বে। শিল্প এবং শেয়ার বাজারের জন্য এটি ভাল খবর হতে পারে। স্টেট ব্যাঙ্কের পর গত সপ্তাহে আমানতে সুদ কমিয়েছে বড় মাপের কয়েকটি বেসরকারি ব্যাঙ্ক। সময় থাকতে চড়া সুদে যাঁরা দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাঙ্কে টাকা রেখেছেন, তাঁরা এখন নিজেদের ভাগ্যবান মনে করবেন।
প্রশ্ন হল, বাজারের এই উত্থানকে ধরে রাখা কতটা সম্ভব? সংস্কারকে কেন্দ্র করে ঘরে-বাইরে সরকারের উপর যে রকম চাপ বাড়ছে, তাতে এখন দেখারএই সংস্কার সরকার কতটা ধরে রাখতে এবং এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। চালচলন দেখে মনে হয়, সরকার অঙ্ক কষেই মাঠে নেমেছে। এখন দেখার, চতুর্দিক থেকে আক্রমণ মনমোহন সরকার কেমন সামলায়। নতুন করে সংস্কারের সূচনায় খুশি বিদেশি লগ্নিকারীরা। সংস্কার চালু থাকলে বাড়বে বিদেশি লগ্নি। এর ফলে ডলারের তুলনায় টাকার দাম বাড়বে। শুক্রবার বাজারে বিদেশি লগ্নি বেড়ে ওঠায় এক দিনে টাকার দাম ডলার পিছু বাড়ে ১.১৩ টাকা। ডলার নেমে আসে ৫৪.৩১ টাকায়। সোনার চাকচিক্য এখনও অটুট। শনিবার পাকা সোনার দাম ছিল ৩২,৪৮০ টাকা (১০ গ্রাম)। অর্থনীতি এবং শেয়ার বাজার চাঙ্গা হলে এবং ডলারের দাম কমলে সোনার দাম পড়ার সম্ভাবনা।
বাজার ভাল থাকলে বিলগ্নীকরণের পথে সরকার টাকা তোলায় সচেষ্ট হবে। শুক্রবার ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এমএমটিসি-র ৯.৩৩ শতাংশ, অয়েল ইন্ডিয়া-র ১০ শতাংশ, ন্যালকো-র ১২.৫ শতাংশ এবং হিন্দুস্থান কপার-এর ৯.৫৯ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে সরকার সংগ্রহ করতে চায় ১৫,০০০ কোটি টাকা। বাজার খুশি এই সিদ্ধান্তে। দেরিতে হলেও বরুণদেবতা ঘাটতি অনেকটাই মিটিয়ে দিয়েছেন। ভাল খবর আছে কর সংগ্রহের ব্যাপারেও। অর্থনীতি ঝিমিয়ে পড়া সত্ত্বেও এপ্রিল থেকে অগস্ট এই পাঁচ মাসে নিট প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহ ২৮.১৫ শতাংশ বেড়ে পৌঁছেছে ১,২৩,৯৬৯ কোটি টাকায়। অন্য দিকে, একই সময়ে পরোক্ষ কর সংগ্রহ ২৭ শতাংশ বেড়ে স্পর্শ করেছে ১.৮১ লক্ষ টাকা। এই সময়ে পরিষেবা কর সংগ্রহ বেড়েছে ৪১ শতাংশ। পরিষেবার নতুন সংজ্ঞা কার্যকর হওয়া এবং করের হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এই বাড়তি আদায়। সব মিলিয়ে উন্নতির আভাস আছে। বাজার চায়, এই পথে সরকার ‘পঞ্চাশ ওভার’ খেলে দিক। ব্যাপারটি যদিও সহজ হবে না। তেল নিয়ে শরিকদের যা বিক্ষোভ, তাতে তেলে-জলে শেষ পর্যন্ত মিশে যায় কি না, বাজার এখন তাই দেখার অপেক্ষায়। |