|
|
|
|
উদ্বিগ্ন এবিজি-র চিঠি পার্থকে |
পণ্য খালাসের দ্বন্দ্বে ফের তপ্ত হলদিয়া |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা ও হলদিয়া |
হলদিয়া বন্দরে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পণ্য খালাস নিয়ে যে দ্বন্দ্ব চলছিল, তা প্রকাশ্যে চলে এল মঙ্গলবার। এক শ্রেণির শ্রমিকের বিক্ষোভের জেরে স্যান্ডহেড থেকে একটি জাহাজ বন্দরে ভিড়তেই পারেনি, যা থেকে এ দিন মাল খালাস হওয়ার কথা ছিল। এ হেন পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য অভিযোগের আঙুল উঠেছে রাজ্যের শাসকদল সমর্থিত বন্দর-শ্রমিক সংগঠনের দিকে। পণ্য খালাসের বরাত পাওয়া সংস্থাটি সমস্যার আশু সুরাহা চেয়ে রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছে। প্রশাসনের তরফে উপযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহণের আশ্বাস দেওয়া হলেও সমাধানসূত্র এখনও অধরাই বলে বন্দর-সূত্রের খবর।
হলদিয়ায় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পণ্য খালাসের বরাত পাওয়া ‘এবিজি’ সংস্থার দু’নম্বর বার্থেই এই গোলমাল। তাদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত পণ্য খালাসের সুযোগ না-পাওয়ায় গত দু’বছরে সংস্থার ৩৪ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। সংস্থার দাবি, যেখানে সাড়ে তিনশো লোক দিয়েই দু’টি বার্থে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পণ্য খালাস করা যায়, সেখানে ‘শাসকদলের ইউনিয়নের চাপে’ পড়ে তাদের এক হাজার লোক নিতে হয়েছে, ফলে মাসিক লোকসানের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে দু’কোটি টাকায়। |
|
এবং এই পরিস্থিতিতে এবিজি জানিয়ে দিয়েছিল, বছরে ৯০ লক্ষ টন পণ্য খালাসের সুযোগ না-পেলে তারা হলদিয়া ছাড়বে। বস্তুত এবিজি ৮ সেপ্টেম্বর থেকে হলদিয়ায় কাজ বন্ধ করার নোটিসও দিয়ে দিয়েছিল। তখনই বন্দর-কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন, এবিজি-র দু’টি বার্থে (২ ও ৮ নম্বর) আরও বেশি সংখ্যক জাহাজ পাঠানো হবে। একই সঙ্গে এবিজির ‘নিষ্ক্রমণ নোটিসে’ স্থগিতাদেশ চেয়ে বন্দর-কর্তৃপক্ষ কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী অন্তত আজ, বুধবার পর্যন্ত এবিজি-র হলদিয়ায় থাকার কথা। তার পরেও এবিজি’কে রাখার জন্য কর্তৃপক্ষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু এরই মধ্যে কর্তৃপক্ষের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গিয়ে এ দিন সকাল থেকে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে হলদিয়া বন্দর। কলকাতা বন্দর-সূত্রের খবর: অছি পরিষদের বৈঠকে স্যান্ডহেডে দাঁড়িয়ে থাকা ‘এমভি প্রভু মিহিকা’ নামে একটি জাহাজকে দু’নম্বর বার্থে নোঙর করানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। জাপানের কাওয়াসিকি বন্দর থেকে আসা জাহাজটিতে রয়েছে ২৩ হাজার টন মেটকোক। বন্দর-সূত্রে জানা যায়, ‘মিহিকা’কে দু’নম্বর বার্থে আনা হচ্ছে এই খবর ছড়াতেই ৪-বি বার্থের শ্রমিকদের একাংশ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বন্দরের বাইরে চিরঞ্জীবপুরে ‘মিহিকা’র ক্লিয়ারিং এজেন্টের অফিসে গিয়ে তাঁরা চড়াও হন. অফিসের এক কর্তাকে মারধরও করা হয় বলে অভিযোগ। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, মূলত তৃণমূলের বন্দর শ্রমিক সংগঠনই এই বিক্ষোভ দেখিয়েছে। উল্লেখ্য, ৪-বি বার্থে পণ্য খালাস করে এবিজি-র একটি ‘প্রতিযোগী’ সংস্থা। এ দিনের বিক্ষোভকারীদের অধিকাংশ সেখান থেকেই এসেছিলেন বলে প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে।
এমতাবস্থায় এবিজি সমস্যার সমাধানে এ দিনই রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছে। রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়ে সংস্থার চিফ এগ্জিকিউটিভ অফিসার গুরপ্রীত মালহি আবেদন করেছেন, রাজ্য সরকার তাদের হলদিয়ায় মাল ওঠানো-নামানোর কাজ চালু রাখতে সাহায্য করুক। অন্যথায় আজ, বুধবারের পরে তাদের পক্ষে হলদিয়ায় কাজ করা কোনও ক্রমেই সম্ভব হবে না।
সরকারের কী বক্তব্য?
পার্থবাবু বলেন, “গায়ের জোরে কাউকে বন্দরের কাজে বাধা সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না। রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে কোনও শিথিলতা দেখাবে না।” শিল্পমন্ত্রী এ-ও বলেন, হলদিয়া বন্দরের সমস্যার কথা তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানাবেন, তমলুকের তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গেও কথা বলবেন। “বিষয়টি নিয়ে আমি বন্দরের চেয়ারম্যানের সঙ্গেও কথা বলেছিলাম। তার পরেও কেন সমস্যা মিটছে না, সে সম্পর্কে এ বার খোঁজ নেব” বলেন পার্থবাবু। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কোনও শিল্পসংস্থা যাতে ব্যবসা গুটিয়ে চলে না-যায়, সে ব্যাপারে রাজ্য সরকারের ‘দায়িত্বের’ কথা বলার পাশাপাশি বন্দর-কর্তৃপক্ষকেও সচেতন হতে বলেছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, “বন্দর বা সংশ্লিষ্ট পণ্য খালাসকারী সংস্থা কেউ যাতে চুক্তির খেলাপ না-করে, সেটাও দেখতে হবে।”
হলদিয়া বন্দরে এ দিনের অশান্তি প্রসঙ্গে তৃণমূলের দিকে আঙুল তুলেছে সিটু-ও। সিটু অনুমোদিত পোর্ট অ্যান্ড শোর মজদুর ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক বিমান মিস্ত্রির মন্তব্য, “এবিজি-কে সরিয়ে অন্য খালাসকারী সংস্থাকে জায়গা করে দিতে চাইছে তৃণমূল। বন্দর-কর্তৃপক্ষের একাংশের তাতে সায় রয়েছে।” এবং সেই মতোই এ দিন তৃণমূল ইউনিয়ন নেতা শ্যামল আদকের ‘ইশারায়’ কিছু শ্রমিক ওই হামলা চালিয়েছে বলে বিমানবাবুর অভিযোগ। তাঁর বক্তব্য: “এবিজি চলে গেলে হলদিয়া বন্দরের প্রভূত লোকসান হবে। বন্দর-কর্মীদের বেতন বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে তৃণমূল হলদিয়ায় শিল্প-পরিবেশ নষ্ট করছে।” অন্য দিকে তৃণমূল ইউনিয়নের নেতা শ্যামল আদক বলছেন, “ব্যাপারটা আমি জানিই না। ওখানে যাইনি। কী হয়েছে, তা-ও বলতে পারব না।” তমলুকের সাংসদ তথা হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান শুভেন্দু অধিকারীরও দাবি, ‘‘এমন কোনও ঘটনার কথা আমি শুনিইনি।’’
এক বন্দর-কর্তা জানিয়েছেন, জাপান থেকে আসা জাহাজটি দু’নম্বর বার্থে নোঙর করে পণ্য খালাস করলে বন্দরের আয় হত ৩৬ লক্ষ টাকা। আমদানিকারী সংস্থার সাশ্রয় হত ১৫ লক্ষ টাকা। কারণ, মোবাইল হারবার ক্রেন দিয়ে পণ্য খালাসের পরে দ্রুত জাহাজ খালি করে দেওয়া যেত, আমদানিকারীকে বাড়তি গুণাগার দিতে হত না। সেই কারণেই এবিজি-র বার্থে জাহাজ নোঙর করানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল বলে বন্দর-কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। এক বন্দর-কর্তার কথায়, “এম ভি প্রভু মিহিকা’কে দু’নম্বর বার্থে দিতে গিয়ে যে সমস্যা হল, তাতে অদূর ভবিষ্যতে বন্দরে শ্রমিক-অসন্তোষ আরও তীব্র হবে। যা সামগ্রিক ভাবে জাহাজি মহলের কাছে অশনি সঙ্কেত ছাড়া আর কিছু নয়।” |
|
|
|
|
|