প্রত্যাবর্তনের প্লটে যে অন্তিম লগ্নে এমন বিরিয়ানির মশলা ঢুকবে, তৃপ্তি হবে, আবার বদহজমও করাবে, কে জানত!
রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। দিব্যি খেলছেন রায়না-কোহলি। চিপক জুড়ে উৎসবের মাঝেও দুঃখের ‘পাংচুয়েশন’— সব হল, শুধু যুবির ব্যাটিংটাই দেখা হল না। কিন্তু ক্রিকেটদেবতা বোধহয় অন্য রকম ভেবে রেখেছিলেন।
মিলসের বলে রায়নার মুহূর্তের ছন্দপতন, আর তার রেশ টেনে চিপকে যে শব্দব্রহ্মের সৃষ্টি হল তাকে কী বলা যায়? মেঘের গর্জন? নাকি হিস্টিরিয়া? ড্রেসিংরুমের বাইরে সওয়া ছ’ফুটের চেহারাটা পা দিল কি দিল না, কমেন্ট্রিবক্সে উত্তেজিত রবি শাস্ত্রী: “হিয়ার ইজ দ্য ম্যান!” টিভি ক্যামেরা পাগলের মতো খুঁজে চলেছে মা শবনম সিংহের মুখ। জায়ান্ট স্ক্রিনে ভেসে উঠছে: ‘ওয়েলকাম ব্যাক যুবি।’ এবং এক বছর আগের বিশ্বকাপের ‘ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট’ যেন ‘টাইমমেশিনে’ ফিরে গেলেন চেনা চিত্রনাট্যের সামনে। দশ মাসে আগেও যা তাঁর জন্য বরাদ্দ থাকত।
৫৪ বলে চাই ৮০। পারবেন ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’?
|
উত্তরে যুবরাজ সিংহ যেটা করলেন, সেই রোমাঞ্চকর কাহিনি লিখতে গেলে বোধহয় অ্যালফ্রেড হিচকককেও দু’বার ভাবতে হত। জানুয়ারিতেও যে লোকটার ঠিকানা ছিল আমেরিকার ইন্ডিয়ানাপোলিসের ক্যানসার হাসপাতাল, তিন-তিনবার যাঁকে কেমোথেরাপির যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে, দাঁড়াতে হয়েছে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, সেপ্টেম্বরে সেই একই লোকের ব্যাট থেকে কোন জাদুমন্ত্রে বেরোয় অতীতের মারকাটারি ‘পুল’? কী ভাবে তিনি অবলীলায় ভেত্তোরিকে ফেলে দিতে পারেন মাঠের বাইরে? দেশকে জিতিয়ে আজ মাঠ ছাড়তে পারেননি যুবরাজ। তিনি জিতেছেন, কিন্তু ভারত হেরেছে। শেষ ওভারে তাঁর বোল্ড হওয়ার দৃশ্যটা ধোনির টিমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ট্র্যাজিক বটে, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে তাঁর প্রত্যাবর্তনের কাহিনি মোটেই বিয়োগান্ত নয়। ব্যাটে ২৬ বলে ৩৪। বল করার সময় ম্যাকালামের শট আটকাতে গিয়ে আঙুলে ‘টেপ’ বসেছে। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কলিনের উঁচু ক্যাচটা নিতে কোনও ভুলচুক হয়নি।
সোজা কথায়, মঙ্গলবারের চিপকে যুবরাজ বুঝিয়ে দিলেন, অদম্য ইচ্ছেশক্তি আর মনের জোর থাকলে দুরারোগ্য কর্কটকেও ‘বাপি বাড়ি যা’ বলে বিদেয় করা যায়। ফিরে আসা যায় জীবনের বাইশ গজে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যুবরাজের নির্বাচন নিয়ে কম কথা হয়নি। অনেক বিশেষজ্ঞের রায় ছিল, এই নির্বাচন আদতে ‘ক্যালকুলেটেড রিস্ক’।
|
যুক্তির চেয়ে আবেগকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যুবরাজের বরাবরের ‘গুরু’ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত বলেছিলেন, “ঠিক হল না।” মঙ্গলবার রাতের পর যুবরাজকে নিয়ে আবেগ বনাম যুক্তি যুদ্ধের টানাটানিতে লম্বা দাঁড়ি। পুরনো মেজাজের কভার ড্রাইভ, নিশ্চিত বাউন্ডারি জেনেও পরিচিত ক্ষিপ্রতায় বলকে ধাওয়া করা— কই, কোথাও তো মারণরোগের কোনও চিহ্ন নেই!
রাতে নিজের ব্যর্থতা মেনে নিয়েও ধোনি বললেন, “আজ আমি পারিনি। কিন্তু যুবরাজ ফিরে আসায় টিমের ব্যালেন্সটা ফিরে এল। যেটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে ভীষণ দরকার। দুর্দান্ত কামব্যাক।” হবে না? খিদেটা তো তৈরি হচ্ছিল দুপুর থেকেই।
টুইটারে যুবরাজ লিখে ফেলেন, ‘আর পারছি না। কয়েক ঘণ্টা বাকি। প্রার্থনা করছি যেন বৃষ্টি না হয়।’ বিশাখাপত্তনমে না শুনলেও চেন্নাইয়ে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’-র আকুতি শুনেছেন বরুণদেবতা। আর সন্ধে নামতেই চিপকের গ্যালারির দর্শকের হাতে হাতে ঘুরেছে বিশাল ব্যানার। যাতে লেখা ‘ওয়ান বিলিয়ন স্ট্রং।’ দেশের জনসংখ্যা এবং যুবির টুইটার অ্যাকাউন্ট মিলে যে অদ্ভুত ব্যানারের সৃষ্টি। প্রত্যুত্তরটাও কী কম আকর্ষণীয়? |
স্বাগত যুবরাজ। অভ্যর্থনায় দর্শকরা। ছবি: পিটিআই |
মাঠে ঢুকেই দর্শককুলকে সেলাম ঠোকা, বাউন্ডারির ধারে দাঁড়িয়ে দেদার অটোগ্রাফ বিলিযুবরাজ সবই করেছেন ম্যাচের মেজাজের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই। টিম ইন্ডিয়ারও তো ম্যাচের চেয়ে মন বেশি যুবরাজে। নিরীহ বলও ডাইভ দিয়ে যুবরাজকে আটকাতে দেখে মিটিমিটি হেসেছেন জাহির। ডাক্তারদের নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ধোনি সপ্তম ওভারেই তাঁর হাতে বল তুলে দিলেন। ফিল্ডিং পজিশনও স্লিপ নয়, আঙুলে চোট লাগার আগে পর্যন্ত কখনও মিড উইকেট। কখনও সেই পয়েন্টে। যা তাঁর সাম্রাজ্য। মহানায়কের চোখের কোলও তখন আর শুকনো থাকেনি।
এমন আবেগ-সাগর যদি কাউকে নিয়ে তৈরি হয়, ম্যাচ বলতে বিশেষ কিছু আর পড়ে থাকে না। মঙ্গলবার থাকেওনি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে নিজেদের মেপে নেওয়ার শেষ সুযোগে হারের কলঙ্ক, কিউয়িদের ১৬৭ পর্যন্ত বাড়তে দিয়ে ১ রানে হার সবই দিব্যি ঢাকা পড়ে গেল। একটা নামের কাছে যুবরাজ সিংহ!
|
চেন্নাইয়ের স্কোর |
নিউজিল্যান্ড
|
নিকোল বো জাহির ০,
গুপ্তিল বো ইরফান ১,
ম্যাকালাম বো ইরফান ৯১,
উইলিয়ামসন ক অশ্বিন বো ইরফান ২৮,
টেলর নঃআঃ ২৫,
ফ্র্যাঙ্কলিন ক যুবরাজ বো বালাজি ১,
ওরাম নঃআঃ ১৮,
অতিরিক্ত ৩,
মোট ২০ ওভারে ১৬৭-৫।
পতন: ২, ২, ৯২, ১৩৯, ১৪২।
বোলিং: জাহির ৪-০-২৭-১, ইরফান ৪-০-৩১-৩, বালাজি ৪-০-৩৩-১,
যুবরাজ ২-০১৪-০, অশ্বিন ৩-০-৩৪-০, কোহলি ৩-০-২৭-০।
|
ভারত |
গম্ভীর ক ও বো মিলস ৩,
কোহলি ক সাউদি বো ফ্র্যাঙ্কলিন ৭০,
রায়না ক টেলর বো মিলস ২৭,
যুবরাজ বো ফ্র্যাঙ্কলিন ৩৪,
ধোনি নঃআঃ ২২,
রোহিত নঃআঃ ৪,
অতিরিক্ত ৬,
মোট ২০ ওভারে ১৬৬-৪।
পতন: ২৬, ৮৬, ১২০, ১৬২।
বোলিং: মিলস ৩-০-১৭-২, মিলনে ৩-০-৩৬-০, ওরাম ৪-০-২৭-০,
ভেত্তোরি ৪-০-৩৭-০, হিরা ২-০-২০-০, ফ্র্যাঙ্কলিন ৪-০-২৬-২। |
|
|