সম্পাদকীয় ১...
রাষ্ট্রীয় মৃগয়া
মানুষকে নাকি তাহার সঙ্গী দেখিয়া চেনা যায়। ব্যঙ্গচিত্রকর অসীম ত্রিবেদী তাঁহার সঙ্গগুণে গর্বিত বোধ করিতে পারেন। যে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাঁহাকে মুম্বই পুলিশ আটক করিয়াছে, সেই অভিযোগেই ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ এক কালে গাঁধীজিকে আটক করিয়াছিল। বালগঙ্গাধর টিলক হইতে বিনায়ক সেন রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের শিকারের তালিকাটি দীর্ঘ এবং তারকাখচিত। অসীম ত্রিবেদী সেই তালিকায় নবতম সংযোজন। তাঁহার অপরাধ, তিনি ভারতীয় গণতন্ত্র তথা সংসদের সম্পর্কে ব্যঙ্গাত্মক চিত্র আঁকিয়াছেন। ব্যঙ্গ চিরকালই সমালোচনার একটি স্বীকৃত এবং জনপ্রিয় কৌশল। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র সকলের সম্পর্কেই সমালোচকরা বিভিন্ন ধরনের ব্যঙ্গ করিয়া থাকেন, সেই ব্যঙ্গ প্রায়শই তীব্র, কঠোর এবং কটু। বস্তুত রঙ্গব্যঙ্গ কথাটি এক নিশ্বাসে উচ্চারিত হইলেও গায়ে জ্বালা না ধরাইলে রঙ্গ সচরাচর ব্যঙ্গের স্তরে ‘উন্নীত’ হয় না। এবং, সমালোচনার হুল যদি বিঁধাইতেই হয়, তবে রাষ্ট্রের তুল্য লক্ষ্য আর কে হইতে পারে? ‘ক্ষমতার মুখের উপর সত্য বলিবার’ স্বাধীনতাই তো একটি গণতান্ত্রিক সমাজের মহত্তম স্বাধীনতা বলিয়া গণ্য। রাষ্ট্র বা তাহার কোনও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অঙ্কিত ব্যঙ্গচিত্র সেই কারণেই গণতন্ত্রের স্বাভাবিক অঙ্গ। অসীম ত্রিবেদী যাহা আঁকিয়াছেন, তাহা কাহারও রুচির প্রতিকূল হইতে পারে, তাহার শিল্পমূল্য না থাকিতে পারে, কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মাপকাঠিতে সে সকল প্রশ্ন সম্পূর্ণ অবান্তর। তিনি তাঁহার মত প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহার বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’র অভিযোগ সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, অন্যায়, অনৈতিক।
এহ বাহ্য। রাষ্ট্রদ্রোহ বিরোধী আইনটিই মূলত অনৈতিক। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পরে ব্রিটিশ সরকার এই আইন প্রণয়ন করিয়াছিল। এই ইতিহাসটিই বুঝাইয়া দেয়, আইনটি গণতন্ত্রের বিরোধী। ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম রাখিবার জন্য প্রণীত এই আইন স্বাধীনতার পরে রদ করাই সঙ্গত হইত, কিন্তু তাহা হয় নাই। এমনকী প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আইনটি রদ করিবার পক্ষে জোর সওয়াল করা সত্ত্বেও উহা থাকিয়া যায়। প্রশ্ন উঠিতে পারে, আইন থাকিলেই কি তাহা প্রয়োগ করিতে হইবে? ব্রিটেনে অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাষ্ট্রদ্রোহের বিরুদ্ধে আইন প্রণীত হইয়াছিল, শেষ অবধি ২০১০ সালে তাহা (দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে) রদ হয়, কিন্তু এই আইন শেষ প্রয়োগ করা হইয়াছিল ১৯৭২ সালে। কিন্তু ব্রিটেন আর ভারত এক নহে। সে দেশে অনেক আইনই খাতায়-কলমে আছে, কার্যত নাই, এ দেশে আইনকে বিরোধী স্বর দমনের হাতিয়ার ব্যবহার করিবার রাষ্ট্রীয় প্রবণতা বহুলপ্রচলিত এবং দুর্মর। সুতরাং ব্রিটিশরা যে আইন রদ করিয়াছে, ভারত আজও তাহার উত্তরাধিকার বহন করিয়া চলিয়াছে।
এই ধারাবাহিক অন্যায়ের মূলে রহিয়াছে দুইটি সত্য। এক, রাষ্ট্রের চালকদের আত্মবিশ্বাসের অভাব। দুই, তাঁহাদের চিন্তা ও চেতনায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব। একটি যথার্থ গণতান্ত্রিক এবং আত্মবিশ্বাসী রাষ্ট্র বিরূপ সমালোচনায় ভয় পায় না, তাহাকে ব্যঙ্গ করিলে ক্রোধে উন্মাদ হইয়া পড়ে না, যুক্তি সহকারে সমালোচনার জবাব দেয়, ব্যঙ্গের যথার্থ কারণ থাকিলে আত্মসংশোধনের চেষ্টা করে, ব্যঙ্গ অকারণ হইলে স্মিতহাস্যে তাহাকে উপেক্ষা করে। দুনিয়ার বহু দেশে বহু সরকার এবং নেতা এই উদার প্রত্যয়ের পরিচয় দিয়াছেন, দিয়া চলিয়াছেন, তাঁহারা ব্যঙ্গচিত্রে রাষ্ট্রদ্রোহের ভূত দেখেন নাই। এ দেশেও এমন সহিষ্ণুতাই নিয়ম হিসাবে গণ্য হইত, প্রধানমন্ত্রীরা ব্যঙ্গচিত্রীর নিকট অনুযোগ জানাইতেন কেন তাঁহাকে লইয়া চিত্র আঁকেন নাই! অসহিষ্ণুতা তখনও ছিল, কিন্তু ব্যতিক্রম হিসাবে। ভারতের দুর্ভাগ্য, ব্যতিক্রম নিয়মে পরিণত হইতেছে, রাষ্ট্রীয় অসহিষ্ণুতা উত্তরোত্তর বাড়িতেছে। কলিকাতা বা মুম্বইয়ের মতো ‘কসমোপলিটান’ শহরেও তাহার দৌরাত্ম্য অধুনা প্রবল। অম্বিকেশ মহাপাত্র হইতে অসীম ত্রিবেদী, সেই দৌরাত্ম্যের শিকার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.