নিরাশ্রয়ও আশ্রয়চ্যুত হতে চায়।
ছোট ছোট করে কাটা চুল নাড়িয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল এক রত্তি এক বালিকা“ঘুপচি ঘর। দিনের পর দিন বাসি রুটি। কিছু বললেই মারধর। তাই ঠিক করেছিলাম, যা থাকে কপালে, পালিয়ে যাব।” জলপাইগুড়ির ক্লাব রোডের অনুভব হোমে বসে সোমবার প্রায় একই রকমের কথা বলল আরও ১০ বালিকা-কিশোরী। শনিবার তাঁরা ওই শহরেরই বেগুনটারির নিজলয় হোম থেকে গভীর রাতে পালিয়ে গিয়েছেন। পরে সকলেই ধরা পড়ে যান। তাঁদের তখন অনুভব হোমে রাখা হয়েছে।
সারা রাজ্যেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হোমের আবাসিকদের অনেকটা একই ধরনের অভিযোগ। হুগলির গুড়াপের একটি হোমের মানসিক ভারসাম্যহীন আবাসিক যুবতী গুড়িয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে রাজ্য জুড়ে তোলপাড় হওয়ার পরেও পরিস্থিতি যে বিশেষ পাল্টায়নি, তা বোঝা গিয়েছে বেগুনটারি থেকেই। গুড়াপের ওই হোমের আবাসিকদের উপরে নানা ভাবে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। বন্ধ করে দেওয়া হয় হোমটি। আবাসিকদের নানা হোমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন সীমা মান্ডি ও অসীমা সাঁতরা চলে গিয়েছে হুগলির জাঙ্গিপাড়ার মুণ্ডলিকা পঞ্চায়েতের বাগাণ্ডায় জনশিক্ষা প্রচার কেন্দ্রর সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত হোমে। সীমার কথায়, “গুড়াপের হোমে আতঙ্কে থাকতাম। ঘর অন্ধকার থাকত। আলো জ্বলত না। পড়তে পারতাম না।” |
সমাজকল্যাণ দফতরের মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্রের নিজের জেলা মালদহের মনস্কামনা রোডে তাঁর দফতরেরই সরকারি হোমে তিনটি ঘর থাকলেও একটি ঘরে ৪২ জন মহিলাকে ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়েছে। বালুরঘাটের উত্তমাশা এলাকায় একটি সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত হোমে বেশ কিছু দিন আগে আবাসিক বালিকাদের দিয়ে মাটি তোলার কাজ করানোর সময় মাটি ধসে কংক্রিটের স্ল্যাব ভেঙে যায়। তাতে আহত হন তিন আবাসিক বালিকা। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করতে করা হয়। বালুরঘাটেরই শুভায়ন সরকারি হোম থেকে গত দু’বছরে অন্তত ৪৫ জন শিশু ও কিশোর আবাসিক পালিয়েছে। অধিকাংশকেই পুলিশ খুঁজে পায়নি।
দুই মেদিনীপুর জেলায় মেয়েদের একমাত্র সরকারি হোমটিতে কোনও চিকিৎসক নেই। ভরসা বলতে একজন ফার্মাসিস্ট। মেদিনীপুর শহরের এই ‘বিদ্যাসাগর বালিকা হোম’ থেকে ২০০৯ সালের নভেম্বরে দু’দফায় মোট ৯ জন তরুণী পালিয়ে গিয়েছিলেন। ২০১০ সালের মার্চে মোট ১৬ জন তরুণী পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের কয়েকজন অবশ্য পরে উদ্ধার হয়। তবে এত সবের পরও টনক নড়েনি। হোমের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বছর কয়েক আগে এক আবাসিকের শ্লীলতাহানির অভিযোগও ওঠে হোমের এক কর্মীর বিরুদ্ধে।
বিষয়টি এখনও বিচারাধীন।
পুরুলিয়ার আনন্দমঠ হোমে কিন্তু পরিস্থিতি বদলেছিল আবাসিকদের বিক্ষোভ দেখানোর পরে। গত ২৪ জুন হোমের মধ্যে ভাঙচুর চালিয়ে ৪১ জন আবাসিক প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে পুরুলিয়া শহরে এসে জেলা আদালতের বারান্দায় বসে পড়ে। অভিযোগ ছিল, তাঁরা নানা অব্যবস্থার শিকার। ছাদ চুঁইয়ে কোথাও কোথাও জল পড়ে, আলো নেই। খাবারের মান, হোম কর্তৃপক্ষের একাংশের ব্যবহার নিয়ে অভিযোগের পাশাপাশি দু’টি দুধের শিশু থাকলেও তাঁদের জন্য দুধ জোটে না বলেও অভিযোগ করা হয়। তারপর থেকে কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছে। সংস্কারের কাজও শুরু হয়েছে। বাঘমুণ্ডির কংগ্রেস বিধায়ক নেপাল মাহাতোর কথায়, “আবাসিকেরা ওই ভাবে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে না এলে, যেটুকু হাল ফিরেছে তা-ও ফিরত না।”
সেখানেই আসছে, এই প্রসঙ্গ যে, আবাসিকেরা কোনও কাণ্ড না ঘটালে বা আবাসিকদের সঙ্গে কোনও অঘটন না ঘটলে কি হোমের কার্যকলাপ সরকারের নজরে আসবে না? |
রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “নজরদারি আগে একদম ছিল না। এখন তবু কিছুটা শুরু হয়েছে। তবে আরও অনেক বাড়াতে হবে।” তিনি বলেন, “বাঁকুড়ার একটা বৃদ্ধাদের হোম খাতায় কলমে রয়েছে। টাকা পাচ্ছে, এ দিকে বাস্তবে তার কোনও অস্তিত্ব নেই! আমরা সব দেখে স্তম্ভিত।” তিনি জানান, আবার পুরুলিয়ার জুভেনাইল হোমে কমিশনের প্রতিনিধিরা ঘুরে দেখেছেন, সেখানে কোনও চিকিৎসক নেই। সেখানকার আবাসিকেরা হোমের ফার্মাসিস্টের বিরুদ্ধে মেয়েদের ইঙ্গিতপূর্ণ, অশ্লীল কথা বলার অভিযোগও এনেছে।
তবে ভাল ভাবে পরিচালিত হোমও রয়েছে। যেমন জাঙ্গিপাড়ার হোমটির আবাসিক নবম শ্রেণির ছাত্রী প্রিয়া দত্ত বলে, “এখানে সবাই বন্ধুর মতো ব্যবহার করে।” জলপাইগুড়ির অনুভব হোম নিয়েও অভিযোগ নেই। যেখানে অভিযোগ রয়েছে, সেখানে রাজ্য সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে দাবি মন্ত্রী সাবিত্রীদেবীর।
কী ব্যবস্থা নিচ্ছে রাজ্য সরকার? রাজ্য সমাজকল্যাণ দফতরের সচিব উমা মুখোপাধ্যায় বলেন, “গুড়াপের ঘটনার পরে জেলাশাসকদের বলা হয়েছিল তাঁদের নিজেদের জেলার হোমগুলি সরেজমিন ঘুরে যেন রিপোর্ট দেন। ইতিমধ্যে রিপোর্ট আসা শুরু হয়েছে। এ ছাড়া, প্রতিটি জেলায় জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারদের স্ত্রীদের নিয়ে আমরা একটি পরিদর্শন টিম তৈরি করেছি। তাঁরা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে আচমকা হোমগুলি ঘুরে দেখবেন এবং আবাসিকদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলে সুবিধা-অসুবিধা জানবেন।” তিনি জানান, হোমের নিরাপত্তার প্রশ্নটাও বড় হয়ে উঠছে। অনেক জায়গায় বাইরের লোক ঢুকছে বলে অভিযোগ। আবার অনেক জায়গায় এক সঙ্গে ৯-১০ জন আবাসিক পালিয়ে যাচ্ছেন। সচিবের মন্তব্য, “এর পিছনে হোমের কারও-কারও যোগসাজশ রয়েছে বলে আমরা সন্দেহ করছি। তাই প্রত্যেক হোমে আলাদা করে ২৪ ঘণ্টা পুলিশ প্রহরা বসানোর প্রস্তাব দিতে চলেছি আমরা।” |
হোমের রকমফের |
সরকারি
• স্পেশ্যাল হোম (নাবালক সাজাপ্রাপ্তেরা থাকে)
• অবজারভেশন হোম (বিচারাধীন নাবালকদের জন্য)
• স্বাধার হোম (নিরাশ্রয় মহিলাদের জন্য)
|
ডেস্টিটিউট বা কটেজ হোম
নিরাশ্রয় এবং সম্বলহীনদের জন্য।
(সরকারি, বেসরকারিদু’ই-ই হয়)
সব মিলিয়ে রাজ্যে প্রায় ১৬০টি হোম রয়েছে। |
|
সাবিত্রীদেবী জানিয়েছেন, হোমগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে দ্রুত জেলাওয়াড়ি নজরদারি কমিটি গড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আবার সেই জেলাওয়াড়ি কমিটিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে রাজ্য মনিটরিং কমিটি তৈরি হচ্ছে। মন্ত্রী বলেন, “ওই কমিটিতে পাঁচ জনের নাম সুপারিশ করা হয়েছে। এক জন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে কমিটির চেয়ারপার্সন করা হবে। বাকি চার সদস্য হবেন লেখক ও শিল্পীদের মধ্যে থেকে। কমিটির পাঁচ সদস্যের নাম মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও পাঠানো হয়েছে।”
রাজ্যের প্রাক্তন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী বিশ্বনাথ চৌধুরী অবশ্য জানিয়েছেন, তিনি নিজেই সরকারি হোম পরিদর্শন করতেন। তিনি বলেন, “কোথায় জানলা ভেঙেছে, ভবনের কোন কোন অংশের মেরামতির প্রয়োজন রয়েছে, তা দেখেশুনে পূর্ত দফতরকে নিয়ে বসে দ্রুত মেরামতির ব্যবস্থা করেছি। প্রত্যেক মাসে জেলা থেকে মহাকরণে হোমগুলির রিপোর্ট পাঠাতে হতো। তা নিয়ে পর্যালোচনা মিটিং হত।”
প্রাক্তন মন্ত্রী যা-ই দাবি করুন, হোমের হাল যে বাম আমলেও বিশেষ ভাল ছিল না, তা বিভিন্ন ঘটনায় একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে। হোমগুলির আবাসিকেরা কিন্তু এত কিছু বোঝেন না। তাঁদের একটাই কথা, “শুধু এইটুকুই চাই—আমাদের মাথার উপরে যেন এক জন অভিভাবক থাকে।”
|