বুলবুলি ধান না খেলেও এ কালে খাজনা দেওয়ার বালাই নেই। আদায় করবে কে? লোক যে বাড়ন্ত। বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাজনা আদায়ের কর্মী নেই সরকারের। সুতরাং খাজনা না দিয়েই দিব্যি চলছে।
কিন্তু রাজকোষের তো হাঁড়ির হাল। তাই সরকারের একটি অংশের প্রস্তাব, স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির সদস্যদের কমিশন এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করে খাজনা আদায় করা হোক। তাতে সরকারের আয় যেমন বাড়বে, তেমনই রোজগার হবে লক্ষাধিক মানুষের। কিন্তু সেই প্রস্তাব শুনে বেঁকে বসেছে সরকারেরই আর এক অংশ। তাদের বক্তব্য, কর আদায়ের ভার বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার কোনও বিধি নেই। বিধির বাঁধন কাটানোর কোনও উপায় আছে কি না জানতে বল আপাতত গিয়েছে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের (এজি) কোর্টে।
রাজ্য সরকারের আয়ের অন্যতম মাধ্যম হল জমির খাজনা। ভূমি অধিকর্তার তত্ত্বাবধানে পঞ্চয়েত স্তরে খাজনা অফিস থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেই খাজনা আদায় করা হয়। আদায় করেন গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে থাকা ভূমি সহায়করা। কিন্তু ভূমি সহায়কের বহু পদ বহু দিন ধরেই খালি। যাঁরা আছেন, খাজনা আদায় করতে তাঁরা রাজ্যের সাড়ে তিন কোটি রায়তের ২০ শতাংশের কাছেও গিয়ে উঠতে পারেন না। ফলে ৮০ শতাংশ রায়ত খাজনা না দিয়ে সুখে আছেন।
এ হেন পরিস্থিতিতে সরকারের একটি অংশ খাজনা আদায়ে কমিশন এজেন্ট নিয়োগের প্রস্তাব দেয়। বলা হয়, প্রতিটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে যদি ২০০০ রায়তের কাছ থেকে খাজনা আদায় করার ভার দেওয়া হয়, তা হলে ১৭ হাজার ৫০০টি গোষ্ঠীকে কাজে লাগানো যেতে পারে। প্রতি গোষ্ঠীতে ১০ জন করে সদস্য ধরলে খাজনা আদায়ের কাজ পেতে পারেন ১ লক্ষ ৭৫ হাজার জন। তাঁদের কমিশনের পরিমাণ ১০ শতাংশ ধরা হলে খাজনার বর্তমান হার অনুযায়ী একটি গোষ্ঠী বছরে ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারে। অন্য দিকে লাভ সরকারেরও। ২০১০-১১ সালে ভূমি দফতর নিজের উদ্যোগে মাত্র ১০২ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছিল। কমিশন এজেন্ট মারফত অনাদায়ী ৮০% খাজনা আদায় হলে এক বছরেই রাজস্ব আদায় বাড়বে ৩৭০ কোটি টাকা।
বস্তুত, এই প্রস্তাবকে সামনে রেখে আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের আগেই যাতে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির অম্তত ৫০ হাজার সদস্যকে খাজনা আদায়ের কাজে লাগানো যায়, তার তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। আর তার পরেই উঠেছে আপত্তি।
কমিশন এজেন্ট নিয়োগের প্রস্তাব যাঁরা দিয়েছেন, তাঁদের যুক্তি হল, রাজস্ব আদায়ের এই ব্যবস্থা মোটেই নতুন নয়। পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ পরিবহণ সংস্থা স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুতের বিল আদায় করছে। কলকাতা শহরে পুরসভার হয়ে রাস্তায় গাড়ি রাখার ফি আদায় করছে ৩১টি বেসরকারি সংস্থা। তাতে ফি আদায়ের পরিমাণও বাড়ছে প্রতি বছর। ২০১০-১১ সালে যেখানে ফি আদায়ের পরিমাণ ছিল ৬ কোটি ৬১ লক্ষ, সেখানে ২০১১-১২ সালে আদায় হয়েছে ৭ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা। ফলে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি যদি ভূমি দফতরের তৈরি করা ইলেকট্রনিক রসিদ দিয়ে খাজনা আদায় করে নিয়ে আসে, তা হলে অসুবিধা কোথায়?
এই প্রস্তাবে যাঁদের আপত্তি তাঁদের বক্তব্য হল, এ ভাবে বেসরকারি সংস্থা নিয়োগ করে কর আদায় করা যায় না। মূল্যযুক্ত কর, বিক্রয় কর, আবগারি শুল্ক, স্ট্যাম্প ডিউটি, খাজনা এই পাঁচ রকমের কর (ট্যাক্স রেভিনিউ) আদায় করার দায়িত্ব সরকারেরই। কমিশন এজেন্ট মারফত শুধুমাত্র কর-বহির্ভূত রাজস্ব (নন-ট্যাক্স রেভিনিউ) আদায় করা সম্ভব। বিদ্যুতের বিল বা পার্কিং ফি কর-বর্হিভূত ক্ষেত্র, এর সঙ্গে খাজনা আদায়ের তুলনা টানা চলে না। আদায় হওয়া খাজনার টাকা কমিশন এজেন্ট তাদের তহবিলে রাখবে, তার পর তা জমা পড়বে কোষাগারে। আইনত তা করা যায় না। করের টাকা সব সময় সরাসরি কোষাগারে জমা পড়ার কথা।
এর পাল্টা বলা হচ্ছে যে, ভূমি সহায়কদের আগে তহসিলদারদের দিয়ে খাজনা আদায় করা হত। তহসিলদাররা সেই অর্থে সরকারি কর্মচারী ছিলেন না। খাজনা আদায়ের উপর কমিশন পেতেন। ফলে এক অর্থে তাঁরা কমিশন এজেন্টই ছিলেন।
হাজার হাজার স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে খাজনা আদায়ের অধিকার দিলে তহবিল তছরুপের আশঙ্কার কথাও তুলে ধরছেন প্রস্তাবের বিরোধীরা। তাঁদের বক্তব্য, তহসিলদারি প্রথা তুলে দেওয়ার পিছনে এটাও অন্যতম কারণ ছিল।
সব মিলিয়ে খাজনা নিয়ে রাজ্য সরকারের দু’টি দফতরের চাপানউতোর আপাতত তুঙ্গে। কমিশন এজেন্ট নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে যারা, সেই ভূমি দফতর আবার খোদ মুখ্যমন্ত্রীর অধীনস্থ।
তাতে আপত্তি জানিয়েছে অমিত মিত্রের অর্থ দফতর।
অর্থ দফতরের এক কর্তার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর দফতর প্রস্তাব দিলেও আইনি বৈধতা না থাকলে তা কার্যকর করা যায় না। সেই কারণে এজি-র মতামত নেওয়া হবে।” আর ভূমি দফতরের এক কর্তার মন্তব্য, “প্রস্তাবটি মানলে সঙ্কটের মুহূর্তে রাজস্ব বাড়ত। সুযোগ তৈরি হত কর্মসংস্থানেরও।” |