|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
সন্ত্রাস দমনের নামে বন্দিদের মধ্যে পাল্টা সন্ত্রাস? |
আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফ বি আই) প্রাক্তন স্পেশাল এজেন্ট
আলি এইচ
সওফান যে কাহিনি শুনিয়েছেন, তাতে এই প্রশ্নই অনিবার্য। আলি সওফানের সম্প্রতি প্রকাশিত বইটি পড়েছেন
তাপস সিংহ |
২৯ অগস্ট, ২০০১। রাত ৩টে। ফোনটা বাজছে। ঘুম ভেঙে গেল রামজি বিনালশিব-এর। হামবুর্গের অ্যাপার্টমেন্টে রিসিভার তুলে ঘুম চোখে রামজি: ‘হ্যালো’। ও প্রান্ত থেকে পাল্টা জবাব: ‘হ্যালো।’ গলাটা খুব চেনা। বন্ধু, এক সময় একই ঘরে থাকত। মহম্মদ আটা। ‘কী ব্যাপার?’ আটার জবাব: ‘আমার এক বন্ধু আমাকে যে ধাঁধাঁটা বলেছে সেটা সমাধান করতে পারছি না, তাই তোমায় ফোন করলাম।’ বিনালশিব: ‘ও কে।’ আটা: ‘দু’টো লাঠি, একটা ড্যাশ, আর একটা কেক লাঠির সঙ্গে জোড়া।’
‘গভীর ঘুম থেকে আমাকে জাগালে এই ধাঁধাঁটা শোনানোর জন্য!’ ও প্রান্তে আটা নিশ্চুপ। সে জানে, এই কোড তার বন্ধু ঠিক ঠিক বুঝবে। আগেও তারা দু’জনে নিয়মিত এ ভাবেই কথা বলেছে। আর একটু নীরবতা। তার পর রামজি জানায়, ‘তোমার বন্ধুকে বল সে যেন চিন্তা না করে। খুব মিষ্টি ধাঁধা। গুড বাই।’
বিনালশিব পাকিস্তানে পৌঁছয় ৫ সেপ্টেম্বর। সেখান থেকে বিশ্বস্ত বার্তাবাহক মারফত আফগানিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের কাছে খবর পাঠায়, ‘আমেরিকার উপর বিরাট হামলা হবে মঙ্গলবার, ১১ সেপ্টেম্বর।’ এটাই ছিল মহম্মদ আটা-র সেই ধাঁধা। দু’টি লাঠির অর্থ: 11, লাঠির মাথায় উল্টো করে একটি কেক মানে 9। আর ড্যাশ হল মাঝের স্পেস। সব মিলিয়ে 11-9, অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর। তারিখ লেখার মার্কিন স্টাইলে: 9-11.
কতটা গভীর সেই ষড়যন্ত্র? প্রায় নিঃশব্দে বুনে চলা সেই চক্রান্তের জাল কতটা ঘিরে ফেলেছে এই বিশ্বকে? পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে ওসামা বিন লাদেনকে মেরে ফেলার পরেও কি সেই চক্রান্তের অবসান ঘটল?
আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফ বি আই) প্রাক্তন স্পেশাল এজেন্ট আলি এইচ সওফান যে কাহিনি শুনিয়েছেন, তা অনেক সময়েই হার মানায় হলিউডের স্পাই থ্রিলারকে। তিনি আরও জানিয়েছেন, সি আই এ তাঁদের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করলে হয়তো ৯/১১-র হামলা রোধ করা যেত।
|
‘নিউ ইয়র্ক ওয়াশিংটন লোক ভাল’ |
ফেব্রুয়ারি, ২০০২। কিউবার গুয়ান্তানামো বে-র কয়েদখানা। ৯/১১-র ঘটনার পরে আফগানিস্তান থেকে ধরে আনা এক বয়স্ক মানুষকে প্রশ্ন করেছিলেন আলি: ‘নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটন সম্পর্কে কী জানেন?’ উত্তর এসেছিল, ‘আমি জানি না ওরা ঠিক কী করেছে। তবে আমি নিশ্চিত, ওরা ভাল লোক।’ জিজ্ঞাসাবাদের পর আলি বলছেন, ‘এই মানুষটি আল কায়েদা অথবা ৯/১১ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল, যে নিরীহ লোকগুলোকে ধরে আনা হয়েছে, আল কায়েদা ও তালিবানদের থেকে তাঁদের আলাদা করা।’
নিরীহ মানুষরা কী ভাবে ধরা পড়ত? তার একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক সওফানের বিবরণ থেকে। আফগানিস্তানে আমেরিকার ‘ভাল বন্ধু’ নর্দার্ন অ্যালায়ান্স-এর যোদ্ধারা ট্রাকে চেপে আফগানিস্তানের পাশতুন এলাকা দিয়ে যেত। গ্রামবাসীদের ট্রাকে চড়ার অনুরোধ করত। এদের অনেকেই কখনও গাড়ি চড়েনি। লাফিয়ে ট্রাকে চড়ে বসত তারা। এই যোদ্ধারা বেশির ভাগই তাজিক। পাশতুনদের তারা ঘৃণা করত। তারা সোজা মানুষগুলোকে নিয়ে যেত কাছাকাছি মার্কিন সেনা ছাউনিতে। অফিসারদের জানিয়ে দিত, লোকগুলো তালিবান বা আল কায়েদার। বন্দিপিছু মিলত পঞ্চাশ ডলার! |
|
‘দ্য ব্ল্যাক ব্যানার্স’-এর সি আই এ-লাঞ্ছিত দুটি পৃষ্ঠা। |
গুয়ান্তানামো বে-তে কয়েদিদের ওপর অত্যাচার নিয়ে অনেক কথাই শুনেছি আমরা। মানবতা ও মানবাধিকার রক্ষায় যে দেশ নিজেদের অতন্দ্র প্রহরী বলে দাবি করে, এ ব্যাপারে সেই আমেরিকার অন্যায়কে কার্যত বেআব্রু করে দিয়েছেন সওফান। বলেছেন, গুয়ান্তানামোয় বন্দিদের হাতে-পায়ে শেকল পরিয়ে রাখার জন্য রক্ষীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কোনও বন্দিকে তার সেল থেকে জিজ্ঞাসাবাদের ঘরে আনার প্রয়োজন হলে দু’জন রক্ষী তাকে বয়ে নিয়ে আসেন। কখনও চাকা লাগানো স্ট্রেচারেও তাদের আনা হয়। আলি বলছেন, বন্দিদের সঙ্গে এই ব্যবহার করলে আল কায়েদাকে কার্যত বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে, ওরা নয়, আসলে আমরাই ওদের দেখে আতঙ্কে রয়েছি। এই পদ্ধতিটাই ভুল।
|
আনুগত্যের মূল্য |
আল কায়েদা নেতা শেখ সইদ অল-মাসরি-র অফিসে অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় ঢুকে পড়ল এল হুসেন খার্শতাও। নাইরোবির উড়ান স্কুলে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিল খার্শতাও। ফিরে এসেছে সুদানে। জেনে গিয়েছে, তার গর্ভবতী স্ত্রী কপর্দকশূন্য অবস্থায় সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের খরচ জোগাড়ের জন্য খার্তুমের রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে। অথচ, আল কায়েদার কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা খার্শতাওকে তার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুমতি দিচ্ছে না। তত দিনে আল কায়েদা নেতৃত্ব তাকে ওসামা বিন লাদেনের ব্যক্তিগত পাইলট হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
অল-মাসরি আল কায়েদার আর্থিক দিকটি দেখেন। খার্শতাও তাঁকে বলে, ‘আমার স্ত্রীর সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য পাঁচশো ডলার চাই।’ প্রায় ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে মাসরি বলেন: ‘দুঃখিত, আমরা তোমায় কোনও সাহায্য করতে পারছি না। ওকে মুসলিম হাসপাতালে নিয়ে যাও।’ খার্শতাও জানে, সে হাসপাতালের কী নিদারুণ দশা। উত্তেজিত খার্শতাও বলতে থাকে, ‘এটা যদি আপনার স্ত্রী বা মেয়ে হত, পারতেন ওখানে পাঠাতে? আমি ’৯১ সাল থেকে আল কায়েদার সঙ্গে রয়েছি। এ ভাবেই কি আপনারা আমার আনুগত্যের মূল্য চোকালেন?’ ছিটকে বেরিয়ে আসে খার্শতাও।
’৯৮-এর ৭ অগস্ট পূর্ব আফ্রিকার দার এস সালাম, তানজানিয়া, নাইরোবি, কেনিয়ায় আমেরিকার বিভিন্ন দূতাবাসে সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনায় কেনিয়া থেকে আরও অনেকের সঙ্গে গ্রেফতার হয় আল কায়েদার নাইরোবি সেলের খার্শতাও। ওই হামলায় মারা গিয়েছিলেন প্রায় ২২৩ জন। আহতের সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু একটি পশ্চিমী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপে ছাড়া পায় খার্শতাও। ওই গোয়েন্দা সংস্থা খার্শতাওকে তাদের এজেন্ট হিসেবে আল কায়েদার অন্দরে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিল।
এ বার আসরে নামে এফ বি আই। কিন্তু খার্তুমে ফিরে যাওয়া আলিকে কী ভাবে নিজেদের হেফাজতে নেওয়া যাবে? তাকে প্রত্যর্পণে কোনও ভাবেই রাজি হবে না সুদান। তা ছাড়া, খার্শতাও জেনে যাবে, তাকে এফ বি আই খুঁজছে। এতে ভয়ও পেতে পারে সে। মাঝখান থেকে তাকে নিজেদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে এফ বি আইয়ের। অতএব, মরক্কোর গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপে মরক্কোর অভিবাসন দফতর তাকে ডেকে পাঠায়। তাকে বলা হয়, তার বাচ্চাদের অভিবাসন নিয়ে একটা সমস্যা আছে। সে যেন মরক্কোয় ফেরে। খার্শতাও মরক্কোয় নামা মাত্রই এফ বি আই তাকে ‘নিরাপদ আস্তানা’য় নিয়ে যায়।
সহকর্মীদের নিয়ে খার্শতাওকে জেরা শুরু করেন আলি সওফান। তাকে বলেন, ‘আমরা সবই জানি। যে ব্যবহার তোমার পাওয়া উচিত ছিল, আল কায়েদা তোমার সঙ্গে সেই ব্যবহার করেনি। তোমারই স্বার্থে আমাদের সঙ্গে পুরোপুরি সহযোগিতা করো, আমরাও তোমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করব। মনে রেখ, তোমার স্ত্রীর যখন সিজারিয়ান অপারেশনের প্রয়োজন, সে সময় তিনি রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করছেন। তোমাকে সাহায্য করেনি ওরা। সব থেকে অনুগত এক সদস্যের সঙ্গে কী ব্যবহার করেছে আল কায়েদা!’ আলির এই কৌশল কাজে লাগে। ভাল ব্যবহার পেয়ে ধীরে ধীরে মুখ খুলতে থাকে খার্শতাও। প্রচুর সাহায্যও করতে থাকে এফ বি আই-কে।
|
আবু জুবেইদা |
বিন লাদেনের সঙ্গী আবু জুবেইদা ২০০২-এর মার্চে ধরা পড়ে পাকিস্তানের ফয়সলাবাদ থেকে। আবু জুবেইদাকে জেরা করার পদ্ধতি নিয়েই তোলপাড় হয়ে যায় আমেরিকার প্রশাসনিক ও গোয়েন্দা মহলে। প্রকাশ্যে চলে আসে ‘এনহান্সড ইন্টারোগেশন টেকনিকস’ বলে সি আই এ কী ভাবে আবু জুবেইদাকে জেরা করেছিল। আমেরিকার প্রশাসনের কাছে সি আই এ ওই সন্ত্রাসবাদীকে জেরায় বারো রকমের পদ্ধতি প্রয়োগের অনুমতি চায়। তার মধ্যে ছিল লাগাতার ঘুমোতে না দেওয়া, কালো রঙের ছোট বাক্সের মধ্যে কোনও মতে অভিযুক্তকে পুরে রাখা, বন্দিকে শৌচাগারে যেতে না দিয়ে স্রেফ ডায়াপার পরিয়ে রাখা, তাকে শুইয়ে হাত-পা বেঁধে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে সেই কাপড়ে লাগাতার জল ঢেলে যাওয়া যাতে তার কষ্টের অনুভূতি একেবারে জলে ডুবে যাওয়ার মতো হয় (পরে জানা যায়, জুবেইদাকে জেরার সময় সি আই এ মোট ৮৩ বার এই পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছিল) প্রভৃতি। ২০০২-এর ১ অগস্ট রাত ১০টা নাগাদ আমেরিকার বিচার বিভাগ ওই বারোটির মধ্যে দশটি পদ্ধতি প্রয়োগের লিখিত অনুমতি দেয় সি আই এ-কে। কারণ হিসেবে বলা হয়, সেগুলি বন্দিদের উপর অত্যাচার প্রতিরোধ সংক্রান্ত জেনিভা চুক্তি লঙ্ঘন করবে না। সওফান জানাচ্ছেন, গোপন ডেরায় আবু জুবেইদার সঙ্গে ঠিক কী হয়েছিল, তা সি আই এ টেপে ধরে রাখে। কিন্তু, তদন্তকারীরা তা দেখার আগেই সি আই এ সেগুলি নষ্ট করে ফেলে। পরে সি আই এ-র অভ্যন্তরীণ যে সব ই-মেল প্রকাশ্যে আনা হয় (ডিক্লাসিফায়েড ডকুমেন্টস) তা থেকে জানা যায় সি আই এ-র উচ্চ পদাধিকারীরা ওই সব টেপ তড়িঘড়ি নষ্ট করে ফেলার কথা বলছেন!
|
তোরা বোরা থেকে অ্যাবটাবাদ |
আমেরিকার প্রতিরক্ষা দফতর সূত্রে মেলা তথ্য জানাচ্ছে, ২০০১-এর ১৭ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের তোরা বোরা পার্বত্য অঞ্চলে লুকিয়ে ছিলেন বিন লাদেন। চতুর্দিকে শুধু বরফ। সে সময়েই আমেরিকার বোমারু বিমানের লাগাতার হামলা থেকে কোনও ক্রমে প্রাণ বাঁচে তাঁর। ওসামা বোঝেন, পালাতে হবে সেখান থেকে! অতএব, ঘোড়ার পিঠে চড়ে আরও উত্তরে আফগানিস্তানের কুনার প্রদেশ। পাহাড় আর ঘন অরণ্যের আড়ালে, যাতে আকাশ থেকে নজরদারিতে আমেরিকার গোয়েন্দা বিমানের অসুবিধা হয়। সেখান থেকে অ্যাবটাবাদের উঁচু প্রাচীর ঘেরা আশ্রয়ে ঠাঁই নেওয়ার ফাঁকে কেটে গিয়েছে দীর্ঘ একটি দশক। তারও পরে শেষের সে দিন, ২০১১-র ২ মে। এটা সকলের জানা। কিন্তু, সন্ত্রাসবাদ খতম করতে গিয়ে বন্দিদের মধ্যে পাল্টা সন্ত্রাস ছড়ানোর নীতির প্রতিবাদ করছেন এফ বি আইয়ের এক স্পেশাল এজেন্ট, জানা ছিল না এটা!
|
অন্য লড়াই |
‘দ্য ব্ল্যাক ব্যানারস’ গ্রন্থটির পাতায় পাতায় বিভিন্ন লাইন কালো মোটা দাগ দিয়ে কাটা। কোনও কোনও পাতায় আবার প্রথম লাইন থেকে শেষ লাইন পর্যন্ত এই কালো দাগের জন্য পড়ার কোনও উপায় নেই! এফ বি আই অনুমতি দিলেও সি আই এ সেগুলি ছাপার অনুমতি দেয়নি!
মধ্য রাতের ধাঁধাঁর সমাধান কি সত্যই মিলল?
দ্য ব্ল্যাক ব্যানারস/ইনসাইড দ্য হান্ট ফর আল কায়েদা, আলি এইচ সওফান। সহলেখক ড্যানিয়েল ফ্রিডম্যান। পেঙ্গুইন |
|
|
|
|
|