|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
এ বার দলিত বনাম অনগ্রসর |
সরকারি চাকরির পদোন্নতিতে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত থেকে শুরু হয়ে গিয়েছে ভোটের রাজনীতির
নতুন দর-কষাকষি। প্রশ্ন উঠেছে, অনগ্রসরদেরই বা কেন বাদ দেওয়া হবে? লিখছেন
গৌতম রায় |
সরকারি চাকরিতে তফশিলি জাতি-উপজাতির কর্মচারীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে মৌচাকে ঢিল পড়েছে বলে মনে হয়। এমন একটা সময় ইউপিএ সরকার রাজ্যসভায় এ সংক্রান্ত বিলটি পেশ করে, যাতে মনে হয়, বিরোধী দল বিজেপির সভা ভণ্ডুল করার নিরবচ্ছিন্ন অপপ্রয়াসে কিছুটা অন্তর্ঘাত চালিয়ে বিজেপি নেতৃত্বকে বিপাকে ফেলে দেওয়াই এই বিল পেশের সময়-নির্বাচনের কারণ। তবে আজ-না-হোক-কাল, এ-বিল সংসদে আনতেই হত। বিশেষত সুপ্রিম কোর্ট পদোন্নতিতে সংরক্ষণের সরকারি সিদ্ধান্ত খারিজ করে দেওয়ার পর।
সরকারি চাকরিতে দলিত, জনজাতি ও অনগ্রসরদের জন্য সংরক্ষণের কোটা থাকলেও চাকরির ‘প্রোমোশন’ অর্থাৎ পদোন্নতির ক্ষেত্রে যোগ্যতাকেই এত দিন পর্যন্ত একমাত্র মাপকাঠি গণ্য করা হত, সামাজিক পশ্চাৎপদতাকে নয়। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও সংরক্ষণের বন্দোবস্তটি সম্প্রসারিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালত বার বারই প্রশ্ন তুলেছে। প্রার্থী যথার্থই পশ্চাৎপদ কি না, তিনি সামাজিক বৈষম্যের শিকার কি না এবং তাঁর পদোন্নতিতে সংস্থা বা পরিষেবার গুণগত উৎকর্ষ অক্ষত থাকবে কিনা, এই তিনটি শর্ত আদালত আরোপ করে থাকে। এ ব্যাপারে দলিতদের বক্তব্য হল, সংরক্ষণ কেবল চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে থাকায় উচ্চতর পদে প্রায় কখনওই দলিতরা উঠতে পারে না। আর সংরক্ষণ-বিরোধীদের বক্তব্য হল, পদোন্নতিতেও কোটা চালু হলে সংস্থার গুণগত গঠন ও পরিষেবার মান অবনমিত হবে, মেধা ও যোগ্যতার কোনও ভূমিকাই সরকারি ক্ষেত্রে থাকবে না।
|
কার লাভ কার ক্ষতি |
সংসদের ভিতরে-বাইরে, পরিষদীয় রাজনীতির বৃত্তে যাঁরা এই সংরক্ষণ-প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন, তাঁরা অবশ্য সরকারি চাকরিতে পদোন্নতিকে সাধারণ ভাবে খারিজ করার দাবি তুলছেন না। তাঁদের দাবি-- সংরক্ষণের এই বন্দোবস্তটি অনগ্রসরদের ক্ষেত্রেও প্রসারিত হোক। রাজ্যসভার কক্ষে বহুজনসমাজ পার্টি ও সমাজবাদী পার্টির সাংসদরা যখন পরস্পরের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন, তখন এটাই ছিল তাঁদের বিরোধের উপলক্ষ। এই সংরক্ষণের প্রশ্নটি যে প্রধানত উত্তরপ্রদেশ, বিহার তথা উত্তর ভারতের সমাজ ও রাজনীতিকে আলোড়িত করছে, এমন নয়। মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুর রাজনীতিকরাও আন্দোলিত। ইউপিএ সরকার প্রধানত দলিত ও জনজাতি ভোটের দিকে তাকিয়েই এমন একটা বিল তৈরি করেছে, যাতে ১১টি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন ও ২০১৪-য় অনুষ্ঠেয় লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের অনুকূলে দলিত ভোটের সমাবেশ নিশ্চিত করা যায়। তবে মুলায়ম সিংহের মতো অনগ্রসর মসিহা ও যাদব কুলপতির আশঙ্কা, কংগ্রেস নয়, এই সংরক্ষণ-ব্যবস্থা উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীর হাতকেই শক্ত করবে। যে দলিতরা মায়াবতীর সর্বজনসমাজের তত্ত্বে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিধানসভা নির্বাচনে তাঁকে পরিত্যাগ করেছে, তা আবার তাঁর দিকে ফিরে আসতে পারে। তাতে শুধু মায়াবতীর লাভ নয়, মুলায়মের ক্ষতিও। তাই মুলায়মের অনুগামী সাংসদরা দলিতদের সংরক্ষণ নিয়ে আপত্তি না করেও অনগ্রসরদের ক্ষেত্রেও ওই কোটা সম্প্রসারিত করার দাবিতে মুখর। একটা সহজ অঙ্কে হিসাবটা পরিষ্কার হবে। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় ৮৪টি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে সমাজবাদী পার্টি এ বার ৫৪টি দখল করেছে, মায়াবতী পেয়েছেন ১৭টি। দলিত-আদিবাসীদের পদোন্নতির কোটার প্রকাশ্য বিরোধিতা করলে মুলায়মের পক্ষে এই আসনগুলি জেতা দুঃসাধ্য হবে। তাই দলিত কোটার বিরোধিতা নয়, অনগ্রসরদের জন্যও একই কোটার দাবি। |
|
প্রত্যাশিত। অখিল ভারতীয় যদুবংশী মহাসভা ট্রাস্টের প্রতিবাদ। দিল্লি, ২ সেপ্টেম্বর,ছবি :পি টি আই |
একই মুখরতা মহারাষ্ট্রের শিব সেনা এবং তামিলনাড়ুর ডিএমকে-র নেতাদেরও। এই দুই দলই পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে অনগ্রসরদের সংগঠন। দলিত সংহতির যে-কোনও সম্ভাবনাই তাদের কাছে সমূহ অশনি-সঙ্কেত। কারণ দলিতরা বহুধা-বিভক্ত থাকলে তবেই অনগ্রসররা উচ্চ বর্ণের সঙ্গে দর-কষাকষির ক্ষেত্রে নিজেদের সুযোগসুবিধা বাড়িয়ে নিতে পারবে। ডিএমকে তো অনগ্রসরদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণে জাতীয় রেকর্ডের অধিকারী। এত বেশি সংরক্ষণ আর কোনও রাজ্যে নেই। আর অম্বেডকরের রাজ্য মহারাষ্ট্রে রিপাবলিকান পার্টির দলিত গোষ্ঠীগুলির মধ্যে বিভাজন শিব সেনার পক্ষে উগ্র মরাঠা খণ্ডজাতীয়তা উসকে তুলতে সহায়ক হয়েছে। শিব সেনা এবং বিজেপি সরাসরি সংবিধানের ১৬ (৪) অনুচ্ছেদের সংশোধনের বিরোধিতায় নেমেছে এ জন্যই। লালুপ্রসাদও যে পদোন্নতিতে দলিত কোটার বিরোধিতা করবেন, এটা প্রত্যাশিতই ছিল। যা ততটা প্রত্যাশিত নয়, তা হল কংগ্রেসের অন্ধ্রপ্রদেশের সাংসদ হনুমন্ত রাও পর্যন্ত সরকারের বিল আনার বিরুদ্ধে চলে গেলেন। দলীয় নেতৃত্বের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করেই তিনি অনগ্রসরদের জন্য কোটার দাবিতে সরব।
|
নতুন বিভাজিকা |
দেখা যাচ্ছে, ইউপিএ কিংবা এনডিএ, কোনও রাজনৈতিক জোটই সংরক্ষণের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারছে না। এনডিএ-র দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক নীতীশ কুমার-শরদ যাদবের সংযুক্ত জনতা দল যেমন সরকারি বিলটি সমর্থন করেছে। তত্ত্বগত ভাবে অর্থাৎ খাতায়-কলমে এই দলের কিন্তু বিলটির বিরোধিতা করার কথা। বিহারে ‘সংযুক্ত জনতা’র সমর্থনভিত্তির প্রধান উপাদান কুর্মিরা, যারা মণ্ডল কমিশন অনুযায়ী অনগ্রসর। কিন্তু অপ্রধান উপাদান হলেও নীতীশ কুমারের ‘মহাদলিত’ জোটও সেই গণভিত্তির পক্ষে প্রয়োজনীয়। নীতীশ কুমার এক দিকে যেমন অনগ্রসর যাদব সম্প্রদায়ের উপর লালুপ্রসাদের প্রভাব খর্ব করতে কৃষ্ণ-উপাসক ও বলরাম-উপাসক সম্প্রদায়ের মধ্যে যাদবদের বিভাজিত করে দিয়েছেন, অন্য দিকে তেমনই কয়েকটি দলিত গোষ্ঠীকে ‘মহাদলিত’ আখ্যা দিয়ে তাদের উন্নয়নে সরকারি বরাদ্দ বাড়িয়ে তাদের পক্ষে টেনে এনেছেন। এই মহাদলিত জোটই রামবিলাস পাসোয়ানের লোকজনশক্তি পার্টির দলিত ভিত্তি ধসিয়ে দিতে পেরেছে। তাই নীতীশ কুমার-শরদ যাদবরা এমন কিছু করবেন না, যা তাঁদের শাসনক্ষমতার ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে। এনডিএ-র তোয়াক্কা না করে জনতা দল তাই ইউপিএ-র সংবিধান সংশোধনী বিল সমর্থন করেছে। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ কার্যকর করার পর সারা দেশের রাজনীতিতে যে বিভাজন দেখা গিয়েছিল, পদোন্নতিতে দলিত কোটা মঞ্জুর এবং আপাতত অনগ্রসর কোটা নামঞ্জুর হওয়াকে কেন্দ্র করে তেমন কোনও পরিস্থিতির উদ্ভব হবে কি না, এখনই বলা কঠিন। তবে তার লক্ষণগুলো ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশ সহ সমগ্র উত্তর ভারতে যেমন অনগ্রসরদের সরকারি সংগঠন দু’ দিন ব্যাপী ধর্মঘট ডেকে দেয়। দলিতদের ‘আরক্ষণ বচাও সংঘর্ষ সমিতি’ বনাম অনগ্রসরদের ‘সর্বজনহিতায় সংরক্ষণ সমিতি’র স্বেচ্ছাসেবকরা পরস্পরকে তাক করে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছেন। দুটো সংগঠনই রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্ট। বিজেপির মতো উচ্চ বর্ণের দল এই সংঘর্ষে অনগ্রসরদের শিবিরে যোগ দেবে, নাকি দলিত-জনজাতির শিবিরে, তা নিয়ে এখনও দ্বিধান্বিত। তবে পাল্লা হয়তো অনগ্রসরদের দিকেই ঝুঁকবে। আবার উত্তরপ্রদেশের নির্দিষ্ট প্রেক্ষিতে বিজেপির অভিজ্ঞতা রয়েছে মুলায়ম সিংহ যাদব এবং মায়াবতী, উভয়ের সঙ্গেই প্রকাশ্যে বা প্রচ্ছন্নে সংসার পাতার। তবু মণ্ডলায়ন-উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে কমণ্ডলুর দলের পক্ষেও অনগ্রসরদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নির্বাচনী রাজনীতি অনুশীলন করা একপ্রকার অসম্ভব। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পুরোহিত কল্যাণ সিংহ, সাধ্বী উমা ভারতী, সকলেই তো অনগ্রসর। তা ছাড়া হিন্দুত্বের পার্টির পক্ষে দলিতদের চেয়ে অনগ্রসরদের হাত ধরা তুলনায় সহজও। |
|
|
|
|
|