পরমাণু-বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রতিবাদ ও তা মোকাবিলায় প্রশাসনিক তৎপরতায় ফের অশান্ত হয়ে উঠল তামিলনাড়ুর কুড়ানকুলাম। বিক্ষোভ সামলাতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ গেল এক মৎস্যজীবীর।
পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লিতে জ্বালানি ভরার প্রতিবাদে গত দু’দিন ধরে কুড়ানকুলামে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আজ পরিস্থিতি রীতিমতো ঘোরালো হয়ে ওঠে। হাজার দু’য়েক বিক্ষোভকারী বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ঘিরে ফেলার চেষ্টা করেন। চলে রেল ও রাস্তা অবরোধ, আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় গ্রাম পঞ্চায়েত এবং গ্রামীণ প্রশাসনের অফিসে। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে পুলিশ জল-কামান, কাঁদানে গ্যাসের সঙ্গে লাঠিচার্জও করে। শেষে গুলি চালায়।
আর তাতেই মৃত্যু হয় বিক্ষোভকারী এক মৎস্যজীবীর। পুলিশ জানিয়েছে, বছর চুয়াল্লিশের ওই ব্যক্তির পরিচয় এখনও অজ্ঞাত। প্রশাসনের দাবি, সমুদ্রতীরবর্তী গ্রাম মানাপাদের রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ চলছিল। |
পুলিশের লাঠি এড়াতে সমুদ্রে নেমে পড়েছেন বিক্ষোভকারীরা। সোমবার কুড়ানকুলামে। |
পুলিশ পৌঁছালে সংঘর্ষ শুরু হয়। ফলে পুলিশ গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। তাতেই ওই ব্যক্তি মারা যান।
কুড়ানকুলামে পরমাণু-বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধীরা গত এক বছর ধরে শান্তিপূর্ণ ভাবেই বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন। আজ হঠাৎ তার ধরন বদলে গেল কেন?
গ্রামবাসীরা আঙুল তুলছেন পুলিশের দিকেই। তাঁদের দাবি, পুলিশ আচমকা কাঁদানে গ্যাস আর জল-কামান চালিয়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেছিল, তাঁরা শুধু প্রতিবাদ করেছিলেন। তাতেই পুলিশ মারমুখী হয়ে ওঠে বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ। পুলিশের পাল্টা বক্তব্য: বিক্ষোভকারীরা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছিল। পুলিশ দেখে তারা চটি, পাথর ইত্যাদি ছুড়তে থাকে, যাতে চার জন পুলিশকর্মী আহত হন। তাড়া খেয়ে বিক্ষোভকারীরা সমুদ্রের দিকে পালায়, শেষে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এর পরে বিক্ষিপ্ত ভাবে রাস্তা ও রেল অবরোধ চলে। কিছু লোক গ্রামে ঢুকে পঞ্চায়েত ও গ্রামীণ প্রশাসনের অফিসে আগুন লাগায়। পুলিশ গ্রামে ঢুকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে আর এক প্রস্থ খণ্ডযুদ্ধ বাঁধে। তখনই পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয় বলে কর্তাদের দাবি। |
এক মহিলা বিক্ষোভকারীকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। সোমবার কুড়ানকুলামে। |
এ দিকে কুড়ানকুলামে গুলিচালনার ঘটনার নিন্দায় মুখর হয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। কেন্দ্রীয় সরকার ও তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার উদ্দেশে তাদের আবেদন, কুড়ানকুলাম পরমাণু-বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন শুরু না-করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হোক। ঘটনাটি ঘিরে রাজনীতির পারদও চড়ছে। বিক্ষোভকারীদের উপরে ‘পুলিশি দমনপীড়নের’ প্রতিবাদ করে বিজেপি দায়ী করেছে দিল্লির ইউপিএ সরকারকেই। অন্য দিকে কুড়ানকুলাম-কাণ্ডের জন্য কেন্দ্র দায়ী করেছে কিছু বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে।
উল্লেখ্য, গত ফেব্রুয়ারিতেও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ কুড়ানকুলামে বিক্ষোভের পিছনে কিছু মার্কিন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ভূমিকার কথা বলেছিলেন। আজ সেই একই সুর শোনা গিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দের গলায়। একটি সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, “বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো এই আন্দোলনকে সমর্থন করছে। আমরা খুব ভাল ভাবেই জানি, এর পিছনে কোন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর হাত রয়েছে।” শিন্দের দাবি, পরমাণু-বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্পর্কে কেন্দ্র সংবেদনশীল। ভারতে এই বিদ্যুৎ উৎপাদন সুবিধাজনক বলেই সরকার তার চেষ্টা চালাচ্ছে।
রাজনীতির চাপান-উতোর যা-ই চলুক, সোমবার দিনের শেষে কুড়ানকুলাম জুড়ে প্রায় বন্ধের ছবি। দোকানপাট সব বন্ধ, রাস্তা সুনসান। পুলিশ আটকাতে ইদিন্তাকরাইমুখী রাস্তাগুলো খুঁড়ে ফেলা হয়েছে। এলাকায় শান্তি বজায় রাখতে নামানো হয়েছে প্রায় চার হাজার নিরাপত্তারক্ষীকে। কুড়ানকুলামের প্রথম ইউনিটে উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা আগামী ডিসেম্বরে। কিন্তু খারাপ আবহাওয়া এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিবাদের জেরে গোটা প্রকল্পটিই অনিশ্চয়তায় ভুগছে। পরমাণু-বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয়তার আশঙ্কায় প্রকল্পটির বিরোধিতা করছেন বাসিন্দারা। সম্প্রতি মাদ্রাজ হাইকোর্ট কুড়ানকুলামের দু’টি চুল্লিতে ইউরেনিয়াম জ্বালানি ভরার কাজ শুরু করার নির্দেশ দেয়। এবং সেই নির্দেশ পালনের মুখেই নতুন করে অশান্তির জালে জড়িয়ে পড়ল কুড়ানকুলাম।
|