একটানা এগারো বছর ধরে লড়াই চালানোর পরে অবশেষে ‘সবচেয়ে বড় শত্রু’ আমেরিকার সঙ্গে হাত মেলাতে রাজি হওয়ার বার্তা দিল তালিবান! এমনকী ঘনিষ্ঠতম মিত্র আল কায়দার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগেও আপত্তি নেই তাদের! সদ্য প্রকাশিত একটি রিপোর্টে এমনই দাবি করেছে ব্রিটেনের বিশেষজ্ঞ সংস্থা রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (আরইউএসআই)। তালিবান-প্রধান মোল্লা ওমরের চার ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলেই এমন তথ্য মিলেছে বলে দাবি তাদের।
আরইউএসআই তথা ‘রুসি’-র রিপোর্টটি প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ঘিরে শুরু হয়েছে জল্পনা। উঠছে প্রশ্নও। রুসি-র দাবি, মোল্লা ওমর-ঘনিষ্ঠদের অনেকেই মনে করছেন, আল-কায়দার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রেখে ভুল করেছিলেন তাঁরা। আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধে জেতা অসম্ভব, তা-ও মেনে নিচ্ছেন তাঁরা। তাই যুদ্ধবিরতির ভাবনা। রুসি-র দাবি মার্কিনদের সঙ্গে তাঁদের ‘স্বাভাবিক শত্রুতা’ আছে বলে মনে করেন না ওই নেতারা।
আর সে কারণেই কয়েকটি শর্ত মানলে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনার উপস্থিতি মেনে নিতেও আপত্তি নেই তালিবানের। তার মধ্যে প্রধান হল, ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ হলেও দেশের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে কোনও রকম আলোচনা করতে নারাজ তারা। তবে এই শান্তি-পর্বে পা রাখার আগে একটিই ‘কাজ’ বাকি, তা হল মোল্লা ওমরের অনুমোদন।
আর এখানেই উঠছে প্রশ্ন। মাত্র ক’দিন আগেই ঈদ-উল-ফিতরের বার্তায় মোল্লা ওমর আগের মতোই চড়া সুরে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘শহরে-গ্রামে, এমনকী নিজেদের দুর্গেও শত্রুদের শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে দেবে না জেহাদিরা’। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চালিয়ে এখন একটু বিরতি চায় তালিবান। তাই এই প্রস্তাব। রিপোর্টে রুসি দাবি করেছে, তালিবানের সঙ্গে শান্তি-চুক্তি হলে ২০১৪ সালের মধ্যে অধিকাংশ মার্কিন সেনা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যেতে পারবে। তালিবান নেতৃত্বের মতে, এটা আমেরিকার কাছে বড় সুযোগ। তবে আফগানিস্তানের পুনর্গঠনের জন্য নিরাপত্তা প্রয়োজন। তাই কন্দহর, হেরাট, জালালাবাদ, মাজার-ই-শরিফ ও কাবুলের ঘাঁটিতে কিছু মার্কিন সেনার উপস্থিতি মেনে নেবে তারা। রুসি-র দাবি, আমেরিকার থেকে সামরিক সাহায্যের পাশাপাশি আর্থিক সাহায্য, এমনকী আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পাওয়ার আশায় তালিবান।
তবে তালিবান নেতৃত্বের কিছু শর্ত আছে। বর্তমান আফগান সংবিধান কোনও মতেই মানতে রাজি নন তাঁরা। হামিদ কারজাই এবং তাঁর ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতেও তাঁরা রাজি নন। পাশাপাশি যুদ্ধবিরতিকে যেন আত্মসমর্পণ বলে মনে না হয়, সে দিকেও সচেতন থাকতে হবে বলে মনে করেন তাঁরা। তাঁদের বক্তব্য, আমেরিকা আফগানিস্তানের ঘাঁটি থেকে পাকিস্তান বা ইরানে হামলা চালাতে পারবে না। তবে এ নিয়ে তালিবান নেতৃত্বের মধ্যে মতভেদ আছে, দাবি রুসির।
তালিবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনার বিষয়টি নতুন নয়। আগেই ‘নরমপন্থী’ তালিবানের সঙ্গে আলোচনায় উদ্যোগী হয়েছিল আমেরিকা। হামিদ কারজাই নিজেও জানিয়েছিলেন, তালিবানের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে। কাতারের দোহায় একটি ‘রাজনৈতিক অফিসও’ খুলেছিল তালিবান। কিন্তু মার্চ মাসে তারা জানিয়ে দেয়, আমেরিকার অবস্থান স্পষ্ট নয়। তা-ই আলোচনা চালিয়ে কোনও লাভ নেই।
এখনও পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা বন্ধ করেনি তালিবান। আফগানিস্তান যুদ্ধের গোড়ায় তারা যে সব এলাকায় কর্তৃত্ব হারিয়েছিল, সেগুলির বেশির ভাগ অংশেই এখন তারা ক্ষমতায়। তালিবানের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন লড়াই চালিয়েছিল নর্দার্ন অ্যালায়েন্স। ওই জোটের অনেক নেতাই এখন কারজাই সরকারে সামিল। তালিবানের সঙ্গে যে কোনও সমঝোতার তাঁরা তীব্র বিরোধী। তা-ই তালিবানদের সঙ্গে সমঝোতা কতটা এগোবে, বা এগোলেও তা কত দূর ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। |