শুধুই ‘খোঁজখবর’ নেওয়া। তদন্তের এক্তিয়ার নেই। এ ভাবেই কাজ শুরু করতে চলেছে রাজ্যে নতুন তৈরি হওয়া দুর্নীতি দমন শাখা। ইতিমধ্যে নবমহাকরণে তাদের অফিস দিয়েছে পূর্ত দফতর। অফিসার নিয়োগও প্রায় চূড়ান্ত।
মুখ্যমন্ত্রীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে ওই দুর্নীতি দমন শাখা। প্রতি মাসে কাজকর্মের বিস্তারিত তথ্য পাঠাতে হবে তাঁর কাছে। বিজ্ঞপ্তিতে আইজি পদমর্যাদার অফিসারকে মাথায় রেখে ওই শাখা তৈরির প্রস্তাব থাকলেও আপাতত এক জন ডিআইজি-ই দায়িত্ব সামলাবেন। তাঁর অধীনে থাকবেন দুই স্পেশাল সুপার ও চার ডিএসপি-সহ ৩০ জনের একটি দল। তাঁরা মুখ্যসচিবের কাছে তাঁদের কাজের দৈনন্দিন খতিয়ান পেশ করবেন।
রাজ্য ভিজিল্যান্স কমিশনও এই একই কাজ করে। তাদের নিজস্ব দুর্নীতি দমন ব্যুরোও আছে। তা হলে কেন দরকার পড়ল নতুন দুর্নীতি দমন শাখা তৈরির?
রাজ্য প্রশাসনের একাংশের মতে, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পেলে সরকারের কাছে অভিযুক্তের শাস্তির সুপারিশ করতে পারে ভিজিল্যান্স কমিশন। সেই পদ্ধতি বেশ দীর্ঘ। এক পুলিশকর্তা বলেন, “প্রাথমিক ভাবে কমিশনের ইনস্পেক্টরেরাই অভিযোগ খতিয়ে দেখেন। তার পরে ওই ফাইল পুলিশ সুপারের হাত ঘুরে যায় এডিজি-র কাছে। সেখান থেকে দুই কমিশনারের মন্তব্য-সহ রিপোর্ট পৌঁছয় কমিশনের সচিবালয়ে।” তাঁরাই অভিযুক্তের শাস্তির সুপারিশ করেন সংশ্লিষ্ট দফতরের প্রধানের কাছে।
কিন্তু ওই সুপারিশ মানার বাধ্যবাধকতা নেই সরকারের। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “কেন তিনি ওই সুপারিশ মানছেন না, তা জানিয়ে ফের কমিশনে ফাইল পাঠানোর স্বাধীনতা আছে দফতরের সচিবদের।” মহাকরণ সূত্রের খবর, বহু ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা ঘটে। ফলে ভিজিল্যান্স কমিশনকে প্রায়ই অভিযোগের নতুন করে তদন্ত করতে হয়। এতে যেমন সময় নষ্ট হয়, ‘শাস্তি’-র সম্ভাবনাও দীর্ঘায়িত হয়। এক পুলিশকর্তার কথায়, “অনেক ক্ষেত্রে কমিশন রিপোর্ট দিতে এত দেরি করে যে অভিযুক্ত কর্মী অবসরের দোরগোড়ায় পৌঁছে যান। তখন মানবিকতার খাতিরে আর তাঁর রিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ কার্যকর করেন না সচিবেরা।”
মহাকরণের একাধিক অফিসারের মতে, এই কারণেই কমিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতরের অধীনে দুর্নীতি দমন শাখা তৈরি করেছে রাজ্য সরকার। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “যে হেতু মুখ্যমন্ত্রী ওই শাখার কাজ সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করবেন, তাই রিপোর্ট পাওয়া যাবে দ্রুত। সেই রিপোর্টের সূত্র ধরে পরে সিআইডি-কে দুর্নীতির মামলা নথিভুক্ত করে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারে মুখ্যমন্ত্রীর অফিস। এতে দুর্নীতি দমনের প্রক্রিয়া গতি পাবে।”
কিন্তু একই কারণে তো ভিজিল্যান্স কমিশনের দুর্নীতি দমন ব্যুরোকেও শক্তিশালী করা হয়েছে এই আমলেই। চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে ১৯৮৮-এর দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে কমিশনের ওই ব্যুরোকে তদন্তের ক্ষমতা দিয়েছে রাজ্য সরকার। তা হলে সাত মাসের তফাতে ফের কেন নতুন শাখা?
রাজ্য প্রশাসনের একাংশের মতে, ভিজিল্যান্স কমিশন স্বায়ত্তশাসিত হওয়ায় তার উপরে সরকারের নিয়ন্ত্রণ তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই কম। সরকার যেমন কমিশনের সুপারিশ না-ও মানতে পারে, তেমন কমিশনও সরকারের নির্দেশ মানতে বাধ্য নয়। কিন্তু কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতরের অধীনে যে দুর্নীতি দমন শাখা কাজ করবে, তাদের সেই সুযোগ নেই। মহাকরণের এক কর্তা বলেন, “সাধারণ ভাবে অবসরপ্রাপ্ত অফিসারেরা ভিজিল্যান্স কমিশনের মাথায় থাকেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাঁরাই নেন। এক জন কর্মরত অফিসারের উপরে সরকারের যতটা নিয়ন্ত্রণ থাকে, অবসরপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে তা থাকে না।” তাই আগাগোড়া কর্মরত পুলিশ অফিসারদের নিয়ে দুর্নীতি দমন শাখা তৈরি করা হয়েছে বলে মত অফিসারদের একাংশের।
ভিজিল্যান্স কমিশন যাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে, নতুন শাখাও তা-ই করবে। গত ২ অগস্ট জারি করা বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, সরকারি ও আধা সরকারি সংস্থা, পঞ্চায়েত, পুরসভা এবং সোসাইটি ও সমবায়ের যে কর্মীরা রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে চাকরি করেন, দুর্নীতি দমন শাখা তাঁদেরই বিরুদ্ধে খোঁজখবর নেবে। অমিল একটাই। ভিজিল্যান্স কমিশনে যে কেউ দুর্নীতির অভিযোগ জানাতে পারতেন। নয়া বিজ্ঞপ্তিতে তার সংস্থান রাখেনি সরকার। বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমন শাখা সেই সব অভিযোগই খতিয়ে দেখবে যেগুলো সরকার তাদের দেখতে বলবে। |